
কে এম আনিছুর রহমান, কলারোয়া :
পানি উন্নয়ন বোর্ডের অপরিকল্পিত বেড়িবাঁধ ও ¬স্লুইচ গেট নির্মাণ, জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণ ছাড়াও অবৈধ দখলদারদের অত্যাচারে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার বুক চিরে প্রবাহিত কপোতাক্ষ নদ তার গতিপথ পরিবর্তন করেও বাঁচতে পারেনি। বিশেষ করে বিগত ২০০১ সালের বন্যার পর কপোতাক্ষের তলদেশে পলি জমায় স্্েরাত হারিয়ে বুকে কচুরিপানা ও শেওলায় ভরা প্রমত্তা কপোতাক্ষ যৌবন হারিয়ে এখন মৃতপ্রায়। একসময় পলিবিধৌত কপোতাক্ষের দু’তীর সবুজ ফসলে ভরে যেতো। যা’ বর্তমানে জলাবদ্ধতার কারণে দু’তীরের ১৫ হাজার জেলে পরিবারের জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। চরম দারিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করে ওইসব পরিবারের দিন কাটে অনাহারে অর্ধাহারে । জীবন জীবিকার তাগিদে পেশা পরিবর্তনের ফলে কপোতাক্ষের তীরে বসবাসকারি জেলে সম্প্রদায় এখন বিলুপ্তির পথে। একটি বেসরকারী সংস্থার দেওয়া তথ্য মতে হানা যায়, গত ৪১ বছরের ব্যবধানে কপোতাক্ষ নদের সাথে ৮০টি সংযোগ খাল বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা আর শুষ্ক মৌসুমে পানি শুন্যতা দেখা দেয় । নদটির বিচ্ছিন্ন ৮২ কিলোমিটারসহ যশোরের চৌগাছার তাহেরপুর থেকে কেশবপুর, কলারোয়া ও তালা হয়ে খুলনার পাইকগাছা শিববাড়ী পর্যন্ত ২শ’৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ কপোতাক্ষ বর্তমানে মরাখালে পরিনত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণ এবং ৬০ এর দশকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অপরিকল্পিতভাবে নদের দু‘ধারে বেড়ীবাঁধ নির্মাণ করায় ক্রমশই নদের তলদেশ জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা পলিতে ভরাট হতে থাকে। এছাড়া তাহেরপুর থেকে পাইকগাছা পর্যন্ত কপোতাক্ষ নদের উপর ৩৮টি ছোট-বড় ব্রীজ ও প্রায় ৮০টি সংযোগ খালের স্লুইচগেট নির্মাণ করে কপোতাক্ষ নদ শাসনের ফলে পলি জমে ক্রমশঃ নদী ভরাট হয়ে কেশবপুরের সাগরদাঁড়ী হতে ত্রিমোহিনী, কলারোয়ার দেয়াড়া, সরসকাটি, খোরদো, ধানদিয়া, ঝিকরগাছা, বাঁকড়াসহ বিভিন্ন এলাকা বদ্ধ জলাশয়ে পরিনত হয়েছে। অপরদিকে তালা-কলারোয়ার উপর দিয়ে প্রবাহিত কপোতাক্ষ নদ পাইকগাছা পর্যন্ত সরু খালে রূপ নিয়েছে। ফলে নদের দু’তীরে হাজার হাজার হেক্টর চর জেগে উঠেছে। কপোতাক্ষের তীরে বসবাসকারী স্থানীয় লোকজন জানায়, রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে কপোতাক্ষ তীরে জেগে ওঠা চর কারাও দখলে থাকলে তার আবার প্রভাকশালি রাজনৈতিক নেতারা জবর দখল করেন। এমনকি সরকার দলীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা স্থানীয় ভূমি কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় দখল করে কপোতাক্ষ নদকে অস্তিত্ব সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে। তাই কপোতাক্ষ নদ আগামীতে কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
স্থানীয় জেলেরা সাংবাদিকদের জানায়, বছরের প্রায় ৭ মাস জলাবদ্ধতা আর ৫ মাস শুকনো থাকার কারণে সবচেয়ে অসুবিধায় পড়েছে কপোতাক্ষ তীরবর্তী জেলে ও মৎস্যজীবি পরিবারগুলো। প্রাচীনকাল হতে বর্র্ণবৈষম্যের শিকার জেলে ও মৎস্যজীবি পরিবার উচু বর্ণের সমাজপতিদের বাসস্থান অপেক্ষা নিচু এলাকায় এবং পেশার তাগিদে নদের দু‘তীরে বিভিন্ন এলাকায় গোষ্ঠী ভিত্তিক বসবাস শুরু করে। সে অনুযায়ী কপোতাক্ষ তীরবর্তী যশোর, সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলার ৯টি উপজেলায় কপোতাক্ষ তীরবর্তী প্রায় ১৫ হাজার জেলে ও মৎস্যজীবি পরিবার দীর্ঘদিন যাবৎ বসবাস করে আসছে। কালের আবর্তে কপোতাক্ষ যৌবন হারিয়ে বদ্ধ খালে পরিনত হওয়ার কারণে জেলে ও মৎস্যজীবিরা চরম দুর্দিনে পড়েছে।
গতকাল রবিবার সরেজমিনে উপজেলার খোরদো মালো পাড়ায় গেলে আশুতোষ বিশ্বাস (৩৮), হারাধন বিশ্বাস (৩৬), নকুল বিশ্বাসসহ কয়েকজন জানায়,‘বাপ দাদার আমল থেকে এখানে তাদের বসবাস। ছোটবেলায় বাবা কাকাদের সাথে নদে জাল দিয়ে মাছ ধরেছি। উদ্বৃত্ত না হলেও মোটা ভাত মোটা কাপড়ে দিন চলে যেত। ১৫/১৬ বছর আগে থেকে কপোতাক্ষ ভরাট শুরু হওয়ায় আমাদের কপালে দুঃখ নেমে আসতে শুরু করে। স্থান ও পেশা পরিবর্তণ না করতে পেরে যার পর নেই কষ্টে আছি।’
একই পাড়ার অমিয় বিশ্বাস আরো জানান,‘ নদের তলদেশ ভরাট হওয়ার কারণে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে কপোতাক্ষ দু’তীরের অধিকাংশ ঘর বাড়ী তলিয়ে যায়। কপোতাক্ষে উপচে পড়া পানিতে খাদ্য সংকটের পাশাপাশি স্যানিটেশন ও যাতায়াত ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।’
বাউখোলা গ্রামের জেলে পরিমল বিশ্বাস (৫২) জানান, ‘এখানকার অধিকাংশ জেলে রুটি রুজির তাগিদে প্রতি বছর বাংলা সনের আশ্বিন থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য ব্যবসায়িদের সঙ্গে জনপ্রতি ২০ থেকে ৭০ হাজার টাকা চুক্তিবদ্ধ হন। পরিবার পরিজন ছেড়ে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যেয়ে অনেক সময় মালিক ঠিকমত টাকা দেয় না। এরপরও সহ্য করতে হয় জলদস্যুদের অত্যাচার। চুক্তিশেষে এলাকায় ফিরে বছরের বাকী সময় কাটে অন্যের জমিতে কাজ করে বা জাল বুনে। একটি জালের প্রতি হাজার ফাঁস বুনতে ৭’শ টাকা থেকে ৮’শ টাকার বেশী আয় হয় না। জাল বোনার কাজ জেলে পাড়ার মহিলারাই বেশী করে থাকে।
উপজেলার ধানদিয়া ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর মালোপাড়ার বৃদ্ধা অবনী বালা বিশ্বাস জানান, ‘আগে রাতদিন কপোতাক্ষ থেকে মাছ ধরে বিক্রয় করে এবং খেয়ে দিন চলে যেত। বর্তমানে মাছ তো দূরে থাক সমুদ্রে যাবার আগে জাল মেরামত ও সুতা কেনার জন্যেও টাকা জোটে না। ধার দেনা করে সুতা কিনতে হয়। যাদের নৌকা আছে একটু নষ্ট হলে সংস্কারের অভাবে তা নষ্ট হয়ে যায়।’
একই গ্রামের অধীর বিশ্বাস (৪১) আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘কপোতাক্ষ নেই তার মাছ ! সাগরে গিয়ে যে টাকা পেয়েছিলাম তা দিয়ে ঋণ শোধ করেছি। বর্তমানে অন্যের জমিতে দৈনিক মজুরিতে কাজ করে পরিবার পরিজন নিয়ে সংসার চালাচ্ছি। কপোতাক্ষ নির্ভরশীল দু‘তীরের জেলে ও মৎস্যজীবিদের পূর্বে ভালভাবে দিনাতিপাত করলেও বর্তমানে অভাব-অনটন তাদের পিছু ছাড়ছে না। জীবন জীবিকার তাগিদে অনেকেই পৈত্রিক ভিটা ও পেশা ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী জেলা এমনকি ভারতে গিয়ে ইট ভাটার শ্রমিক সহ নানা প্রকার কাজ করতে বাধ্য হয়েছে। আর যারা দেশে আছে তাদের বাঁচার তাগিদে এবং ছেলে মেয়েদের মুখে দু‘বেলা দু‘মুঠো অন্ন তুলে দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এছাড়া লেখাপড়ার খরচ যোগাতে স্থানীয় বিভিন্ন এনজিও এবং মহাজনদের নিকট থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছে। সরকারী ঋণের ক্ষেত্রে নানা শর্ত ও জটিলতার কারণে সে ঋণ জেলেদের ভাগ্যে জোটেনা। বর্ষা মৌসুমে কপোতাক্ষের উপচে পড়া পানিতে বাড়ীঘর তলিয়ে যাবার পর সরকারী এবং স্থানীয় এনজিওদের কাছ থেকে যৎসামান্য ত্রাণ ছাড়া বছরের অন্য সময় ভিজিডি, ভিজিএফ কার্ডসহ সরকারী তেমন কোন সুবিধা তারা পায়না। কাজেই স্থানীয় এবং মহাজনদের নিকট থেকে চড়া সুদে ঋণ নেয়ার কারনে অনেকটা জিম্মি অবস্থায় জেলে ও মৎস্যজীবিদের দিন কেটে যাচ্ছে। যার ফলে যতই দিন যাচ্ছে ততই তাদের জীবনযাত্রা চরম দূর্বিসহ হয়ে উঠছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারী ভাবে জেলে ও মৎস্যজীবিদের জীবন জীবিকার মানোন্নয়নে কথা দিলেও বাস্তবে রূপ নেয় না।
দক্ষিণ চুকনগর কলেজের অধ্যক্ষ ও কেন্দ্রীয় পানি কমিটির সভাপতি শফিকুল ইসলাম জানান, বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে নামমাত্র কপোতাক্ষ খনন করে বরাদ্দকৃত টাকার বড় অংশই লুটপাট করা হয়েছে। বর্তমান সরকার সম্প্রতি কপোতাক্ষ খননের ব্যপারে ২শ’৮০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ঘোষণা করেছেন। ঘোষণা অনুযায়ী কিছু কাজও হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রকল্প অনুযায়ী দীর্ঘ কপোতাক্ষ নদ টিআরএম পদ্ধতিতে নদী শাসন ব্যবস্থা ঠিক রেখে খননের জন্য পানি বিশেষজ্ঞ ও এলাকাবাসী দাবী তুলেছে। দাবী অনুযায়ী খনন হলে হয়তো বদ্ধ কপোতাক্ষ তার হারানো যৌবন কিছুটা হলেও ফিরে পেতে পারে। সাথে সাথে নদের তীরবর্তী এলাকায় বসবাসকারী জেলে পরিবারগুলো ফিরে পেতে পারে তাদের পৈতৃক পেশা ও হারানো ঐতিহ্য।