
সোহরাব হোসেন সবুজ, নলতা:
উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছুফি সাধক হযরত শাহছুফি আলহাজ্ব খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রঃ)’র চিন্তা, চেতনা, মনন, উপলব্ধি ও কর্মকান্ড বিশ্লেষণে এটা প্রতীয়মান হয় যে, তিনি প্রকৃত অর্থেই ‘¯্রষ্টার এবাদত ও সৃষ্টের সেবা’ এই মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত ছিলেন। জীবনব্যাপী এই বিশ্বাস ললন করতে গিয়ে তার মনোজগতে ঘটেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এবং অবশ্যই তা ক্রমবিকাশমান ধারায়। ফলশ্রুতিতে স্রষ্টার মধ্যে লীন হবার অপার আনন্দে তিনি ছিলেন বিভোর। ¯্রষ্টাকে জীবনাচারে মেনে চলেছেন কঠিন ধর্মীয় বিধান আর সৃষ্টিতত্ত্ব পরম্পরায় সৃষ্টের নানা বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যে অবগাহন করেছেন কাক্সিক্ষত স্বপ্নলোকে পৌছানোর জন্যে। সৃষ্টির অপার রহস্য উম্মোচন করার প্রয়াসে তিনি নান্দনিক ভাবনায় নিজেকে যুক্ত করেছেন সীমা থেকে অসীমের যাত্রার কান্ডারী হিসাবে। আর তাই খানবাহাদুর আহছানউল্লার সমগ্র জীবনে এই ছায়া প্রতিবিম্বিত হয়েছে বারবার, যা তার সমগ্র লেখনীতে অত্যান্ত স্পষ্টভাবে জীবনের সব কিছুই সেই পরম প্রভুর উদ্দেশ্যে নিবেদন করতে পেরেছিলেন। তার জীবনাচার, ভাবনা, জীব ও প্রাণী জগতের প্রতি তার মমত্ববোধ সব কিছুই উৎসারিত হয়েছে প্রেমময় অনুভব থেকে। প্রেমের সঞ্জীবনী সুধায় তিনি উদ্ভাসিত করতে চেয়েছেন চারপাশ, দূর করতে চেয়েছেন অন্যায়, অসত্য ও নিপীড়ন। তাই তিনি স্বপ্ন দেখেছেন নিপীড়িত জাতির মুক্তি ও কল্যাণের পথ। মহান রাব্বুল আলামিনের এক অপুর্ব সৃষ্টি এই বিশ্বজগৎ। আল্লাহ যার বদৌলতে এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তিনি আমাদের প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সঃ)। তিনি ছিলেন মানব সমাজের জন্য আলোকবর্তিকা, পৃথিবীর সমস্ত কালিমা আঁধার দুর করে একতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে সমগ্র মানব জাতিকে আবদ্ধ করে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তার জীবনের ব্রত। আর এ বিশ্বাস ধারন করেই খানবাহাদুর আহছানউলাø তার বিভিন্ন লেখায় বলেছেন, নবীজীর নির্দেশিত পথই তার এক মাত্র আদর্শ। আর এই পথে চলতে পারলেই মহা প্রভুর উদ্দেশ্য সাধন হবে। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে প্রেমসূত্রে আবদ্ধ হওয়া, সৃষ্টিকে ভালবাসা এবং সর্বপরি সৃষ্টিকে সংরক্ষণ করার মধ্য দিয়ে পৃথিবী নামক গ্রহটিকে বাসযোগ্য করা যায়, পাওয়া যায় স্রষ্টার একান্ত সান্নিধ্য এই ছিল খানবহাদুর আহছানউল্লা (রঃ)’র জীবন দর্শন।
সৃষ্টির মূলেই নিহিত রয়েছে প্রেমময়ের অনন্ত প্রেম। আর তাই খানবাহাদুর আহছানউল্লা সৃষ্টির অপার রহস্য, ¯্রষ্টা ও সৃষ্টির প্রেমময় সম্পর্ক, এর দৃঢ় অর্থ এবং মানব সমাজের করণীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট দার্শনিক মনোভাবনামূলক পথ নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি তার ‘সৃষ্টিতত্ত’¡ গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন, ‘প্রেমময়ের প্রেম সমুদ্র হইতে উদ্ভুত ভূমন্ডল ও নভোমন্ডল। তিনি আরো বলেছেন, ‘¯্রষ্টা যিনি অনন্ত শক্তি, অনন্ত জ্ঞান, অনন্ত প্রেমের অনন্ত ভান্ডার। সৃষ্টি বলতে আমরা বুঝি যে, একসময়ে কোন বস্তু ছিল না, ক্রমে সৃষ্টি হয়েছে। ইহাতে বোঝা যায় যে, পূর্বে একই সৃষ্টা বিদ্যামান ছিলেন, সারা সৃষ্টি তাহারই অন্তর্নিহিত ছিল, পরে তাহা হইতে উদ্ভুত হইয়াছে। তিনি ছিলেন নিরাকার, আদি শক্তি, সকল মাহাত্ম্য, সকল দয়া, সকল প্রেম, সকল জ্যোতি তাহারই মধ্যে সমাহিত ছিল, কিন্তু সবই ছিল অপ্রকাশ্যমান। নিরাকার বলিলে সত্ত্বাহীন বুঝা নির্বোধিতা।’ তিনি বলেছেন, বিশ্বের প্রতি অণু- পরমানু বিরাট প্রেমের পরিচায়ক। প্রত্যেক বস্তু প্রেমেরই উদ্ভব। এই প্রেম প্রত্যেক পদার্থের অণুপরমাাণুকে আকর্ষণ করিয়া রাখিয়াছে, যাহা সংসক্তি নামে পরিচিত। মাধ্যাকর্ষণ ভূ-ম-ল সহ সমগ্র পদার্থকে পৃথিবীর কেন্দ্রাভিমূখে আকর্ষণ করে, তাহাও সেই বিশ্ব প্রেমের পরিচয়ক। মহাকর্ষণ দ্বারা সমগ্র গ্রহ-উপগ্রহ স্ব স্ব সূর্যের চতুর্দিকে একই নিয়মে আবর্তন করে, তাহাও সেই বিশ্ব প্রেমের পরিচায়ক।
আমরা যদি ¯্রষ্টার নির্দেশিত উপায়ে সৃষ্টির সংরক্ষণ করতে পারতাম তাহলে আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য পৃথিবী হত স্বপ্নের আবাস। খানবাহাদুর আহছানউল্লা (রঃ) একই সাথে স্রষ্টা এবং সৃষ্টির রহস্য উন্মোচন করার চেষ্টা করেছেন। পাশাপাশি সৃষ্টির সেবা করার জন্য সমগ্র মানব জাতির প্রতি উদাত্ত আহব্বান জানিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মানুষ তার জীবদ্দশায় স্রষ্টার নির্দেশিত পথে পরিচালিত হলে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বোপরি সমগ্র বিশ্বের কল্যাণ সাধিত হবে।