
অনলাইন ডেস্ক ::
‘শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে এসে একটাই লাভ হয়েছে, আর তা হলো রাতে খাওয়ার পর ঘুমানোর জন্য ট্যাবলেট খেতে হয়। ব্যবসা করতে এসে দিনের পর দিন লোকসান দিতে দিতে এখন পরিবার-পরিজন নিয়ে কীভাবে দিন কাটাবো এই চিন্তায় রাতে আর ঘুম হয় না। ফলে বাড়তি খাদ্য হিসেবে ট্যাবলেট খেতে হয়।’
এভাবে হতাশা আর ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো বলেন নগরীর প্রাণকেন্দ্র পিকচার প্যালেস এলাকার জয়তুন সিকিউরিটিজ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের মাধ্যমে বিনিয়োগকারী মো. তৌহিদুল ইসলাম পলাশ।
এই বিনিয়োগকারী বলেন, ২০১১ সালে তিনি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেন। ১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে তাকে অনেক দেনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। মাঝে কিছুদিন লাভ হলেও এখন তার বিনিয়োগ থেকে হারিয়ে গেছে ৬ লাখ টাকা। বাকি বিনিয়োগের কী হবে তা নিয়েই সবচেয়ে বেশি টেনশন এখন-বলেন তিনি।
পলাশ বলেন, লোকসান দিতে দিতে এখন খুব অসুবিধায় রয়েছি। দ্রব্যমূল্যসহ বাংলাদেশে সবকিছুর দাম বাড়লেও শুধু শেয়ারবাজারে দাম বাড়ে না। যে শেয়ার কিনবো সেই শেয়ারের দাম কমে যাবে। তাহলে আমরা বিনিয়োগকারীরা যাব কোথায়।
আরেক বিনিয়োগকারী আনোয়ারুল ইসলাম কাজল বলেন, শেয়ারবাজার শেষ। চাকরি করে আয় করা টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছিলাম। কিন্তু তেমন একটা লাভের মুখ দেখা হয়নি। এখন তো প্রায় প্রতিদিনই শেয়ারের দাম কমছে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে টাকা উঠিয়ে আনারও সুযোগ নেই। শেয়ার বিক্রি করাও সম্ভব হচ্ছে না। শেয়ারবাজারের পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। এই মার্কেট বাঁচাতে সরকারের পদক্ষেপ জরুরি।
এই হাউজের ট্রেডার মো. জুয়েল মোড়ল বলেন, শুরুতে তাদের প্রায় ১২ হাজার হিসাব ছিল। তা কমতে কমতে এখন ৪-৫ হাজারে গিয়ে ঠেকেছে। প্রতিদিন শত শত বিনিয়োগকারীর পদচারণায় মুখরিত থাকতো হাউজ। কিন্তু এখন সারাদিনে একশত বিনিয়োগকারীও পাওয়া যায় না। কর্মচারীদের বেতন ঠিকমতো দিতে না পারায় অনেকে অন্যত্র চলে গেছেন। খুলনায় ২৭ ব্রোকারেজ হাউজেরই একই অবস্থা বলেও জানান এই ট্রেডার। ব্যবসা না হওয়ায় বাড়িভাড়াও দিতে পারছেন না অনেকে।
শিববাড়ি মোড়ে খুলনার সবচেয়ে বড় ব্রোকারের হাউজ হিসেবে পরিচিত রয়্যাল ক্যাপিটালের ব্রাঞ্চ ইনচার্জ উজ্জ্বল কুমার সাহা বলেন, এক সময় খুলনার বিনিয়োগ পরিস্থিতি খুবই ভালো ছিল। কিন্তু ২০১০ সালের পর শেয়ারবাজারে বড় ধরনের ধসের কারণে কমে যায় বিনিয়োগকারীর সংখ্যা। সেই সময়ে খুলনার সবগুলো হাউজ মিলে লক্ষাধিক বিনিয়োগকারী থাকলেও অব্যাহত লোকসানের কারণে অনেকে বিনিয়োগের অর্থ উঠিয়ে নিয়েছেন। এখন সবমিলে খুলনায় অর্ধলাখ বিনিয়োগাকারীও পাওয়া যাবে না।
এই হাউজের মাধ্যমে বিনিয়োগকারী মো. হুমায়ূন কবীর বলেন, এখন শেয়ারবাজারে লাভের চেয়ে লোকসানের পরিমাণ অনেক বেশি। কোনো শেয়ারে যদি এক টাকা লাভ হয়, তাহলে অন্য শেয়ারে লোকসান হয় ৫ টাকা। ফলে চার টাকা লোকসান দিয়ে ব্যবসা করা খুবই কঠিন। এখন লোকসান হলেও শেয়ার বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। একদিন দেখি, দুদিন দেখি এমন করতে করতে শুধু লোকসানই হচ্ছে, দাম আর বাড়ছে না।
তিনি বলেন, গত কয়েক মাস আগেও হাউজে ভলিউম কোটি টাকার ওপরে থাকতো। কিন্তু এখন সারাদিনে লাখ টাকা উঠতে খুব বেগ পেতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে শেয়ারবাজারের আয় দিয়ে সংসার চালানো খুব কঠিন হয়ে পড়েছে।
নগরীর স্যার ইকবাল রোডের মাল্টি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের শাখা ব্যবস্থাপক শেখ আল ইমরান বলেন, ২০০৭ সালে খুলনায় তাদের হাউজ ওপেন হয়। সেই সময়ে তাদের ক্লায়েন্ট ছিল দুই হাজার। বিনিয়োগকারীদের আনাগোনা ছিল দিনভর। কিন্তু শেয়ারবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি খুবই ভয়ঙ্কর। বিনিয়োগকারীদের মাথায় হাত উঠেছে অনেক আগেই। নতুন করে আর বিনিয়োগকারী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে যারা বিনিয়োগ করে বসে আছে তারা লোকসানের মুখে তাদের শেয়ার বিক্রি করতে পারছে না। ফলে পুরোনো বিনিয়োগকারীদের প্রতিনিয়ত লস গুনতে হচ্ছে।
খুলনার বর্ষীয়ান শেয়ার ব্যবসায়ী জয়তুন সিকিউরিটিজ ইন্টারন্যাশনালের ম্যানেজার বলেন, শেয়ারবাজারের এই ধস থেকে রক্ষা পেতে হলে দরকার সরকারের হস্তক্ষেপ।
তিনি বলেন, দূরদর্শী কোনো পদক্ষেপ না নিলে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী একেবারে পথে বসে যাবে।
তিনি আরও বলেন, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো যদি আমাদের দেশেও শেয়ারবাজার চালানো যায় তাহলে বিনিয়োগকারীরা লাভবান হবেন। তারা আরও বেশি বিনিয়োগ করবেন।