
সমাজ
॥ উমর ফারুক ॥
সড়কপথে পনেরো ঘণ্টার দীর্ঘপথ। রংপুর থেকে সাতক্ষীরা। গজ-ফিতে দিয়ে মাপলে দূরত্বটা প্রায় সাড়ে পাঁচশ’ কিলোমিটারের কাছাকাছি। পথে পথে অনেক ক’টি জেলা-উপজেলা। অনেক গ্রাম, মেঠোপথ। অনেক বাজার ও চায়ের দোকান। উৎসুক চোখ বারবার পথচলা ও পথস্থির মানুষের দিকে যাচ্ছে। ‘শারীরিক দূরত্ব’ শব্দ দুটি যেখানে শুধুই আভিধানিক; আর মাস্ক শব্দটি কালেভদ্রে দু-একজনের জন্য প্রায়োগিক।
ছ’টার যাত্রা ন’টায় শেষ। বাড়িতে পৌঁছাতেই রাত। দাদার মৃত্যুর পর ছোট্ট শিশুটির সঙ্গে দাদির এবার প্রথমবার দেখা। আলিঙ্গনের ইচ্ছাটি সংবরণ করে গরম জল দিয়ে সাবানস্নান সেরে অতঃপর দু’জন খানিকটা কাছে এলো। সকালে ঘুম ভাঙতেই বাড়িতে মানুষের ঢল। ভাইবোন, খালা-খালু, চাচা-চাচি, মামা-মামি আরও কত আত্মীয়স্বজন! সবাই এসে প্রথমে করমর্দন করতে চান। জড়িয়ে ধরতে চান। গায়ে ভালোবাসার হাত রেখে, মাথায় হাত রেখে জানতে চান, কেমন আছ?
গ্রামের মানুষের ভালোবাসা আসে হৃদয় থেকে। অকৃত্রিম, সবটাই আন্তরিক। লোক দেখানো নয়, লোক ভোলানোও নয়। সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া বিপদে-প্রয়োজনে তারা একে অন্যের পাশে থাকে। আগলে রাখে। একে অন্যের সুখ ভাগ করে নেয়। তাদের এই আন্তরিকতায় ভরা সম্পর্ককে প্রতিবাদ জানানো অনেকটা কষ্টকর। কখনও কখনও অগ্রহণযোগ্যও বটে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, ঈদে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নাকতাড়া গ্রামে বেড়াতে এসেছেন অনেকেই। তারা বাজারে ঘুরেছেন। প্রার্থনালয়ে গেছেন। বিয়ের অনুষ্ঠানে গেছেন। কাউকে কোনো স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যায়নি। বরং মানতে বললে কেউ কেউ উষ্ফ্মা প্রকাশও করেছেন।
ডেকোরেটরকে বলে আগেই বাড়ির মূল ফটকে হাত ধোয়ার অস্থায়ী স্থাপনা বসানো হয়েছিল। কেউ বাড়িতে ঢুকলেই তাকে হাত ধুয়ে বাড়িতে প্রবেশ করার জন্য অনুরোধ করা হলো। কেউ কেউ হেসে উড়িয়ে দিল। কেউ কেউ করল মৃদু প্রতিবাদ। বলল, ‘গেরামে ওসব করোনা-টরোনা নেই। ওসব তোমাগির শহরের রোগ। শহরে থাকে। গেরামে আসে না।’ কেউ কেউ একটু বেশি ক্ষোভ প্রকাশ করল। বলল, ‘আল্লাহ যদি রোগ দেয়, তালি ওসব হাতটাত ধুয়ে কোনো লাভ নেই। মৃত্যু আসলি কেউ বাঁচাতি পারবে না।’ অবশ্য ব্যতিক্রম দু-একজনকে আগ্রহী হয়ে স্বেচ্ছায় হাত ধুতে দেখে ভালো লাগল।
আম্পানদুর্গত এলাকা পরির্দশন ও ‘হিউম্যানিটি বিয়ন্ড ব্যারিয়রস্’-এর উদ্যোগে আর্থিক সহায়তা বিতরণের প্রয়োজনে, দীর্ঘ ঈদযাপনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাত্র কয়েকবারের জন্য ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিলাম। ফেরার পথে নাকতাড়া মাদ্রাসা মোড়ের চায়ের দোকানে একবার উঁকি দিলাম। ছোট্ট ঘর। আনুমানিক আয়তন ১০-১০ ফুট। দূরদর্শনে তখন বাংলা চলচ্চিত্র চলছে। ভেতরে অন্তত ১৫-২০ জনের চোখ আটকে আছে সেই পর্দায়। দোকানির বয়স আনুমানিক তেরো কি চৌদ্দ! কারও মুখে কোনো মাস্ক নেই। দোকানিরও না। শারীরিক দূরত্ব শব্দটি ওখানে খুবই হাস্যকর।
এক সন্ধ্যায় মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বাসায় বেড়াতে এলো আমার এক চাচাতো ভাই। অল্প বয়স। কথা বলতে বলতে জানা গেল, তার ছোট বোন অসুস্থ। খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আজ করোনা পরীক্ষা করতে দিয়ে এসেছে। বিকেলে সে ওখান থেকেই ফিরেছে। জানতে চাইলাম, খুব কি দরকার ছিল মসজিদে গিয়ে জামাতের সঙ্গে নামাজ পড়ার? রিপোর্টটা না আসা পর্যন্ত তো অন্তত বাসায় নামাজ পড়তে পারতিস। সম্পর্কটা দুমড়েমুচড়ে ছেলেটা চলে গেল। কয়েকদিনের মধ্যে গ্রামে আরও কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়ল। কারও জ্বর, কারও শ্বাসকষ্ট। কেউ আবার কাঁপতে কাঁপতে পড়ে যাচ্ছে। অনেকেই আবার কোনো স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা না নিয়েই তাদের সেবা করছেন।
ঈদের সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক মানুষ গ্রামে আসে। এ সময় জুমার মসজিদে একটু বেশি মুসল্লিরও আগমন ঘটে। যে যার মতো আসছে-যাচ্ছে। আগের মতোই গা-ঘেঁষে বসছে। ব্যতিক্রম ছাড়া কারও মুখে কোনো মাস্ক নেই। এক জুমার দিন আমরা পারিবারিকভাবে মসজিদে কিছু মাস্ক বিতরণ করলাম। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য- প্রায় সবাই মাস্ক নিলেন, কিন্তু সবাই পরলেন না। অনেকেই পকেটে রেখে দিলেন। নাকতাড়া জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সেক্রেটারি শফিউল আজমের সঙ্গে কথা হলো। তিনি জানান, আমরা মসজিদে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য লাল রঙের চিহ্নও এঁকে রেখেছি। কিন্তু এটা মানানো কঠিন।
বাজারগুলোর অবস্থা আরেকটু ভয়াবহ। মানুষ মানুষের গায়ের ওপর উঠে যাচ্ছে। পায়ের ওপর উঠে যাচ্ছে। কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। চাচা মাস্ক কই? জানতে চাইতেই কেউ কেউ বুকপকেট দেখাচ্ছেন। কেউ কেউ দেখাচ্ছেন গাঁট। পরেননি কেন? জানতে চাইলেই বলছেন, দম বন্ধ হয়ে যায় বাবা।
করোনা সংকটে পৃথিবী আজ স্তব্ধ। সারাদেশ স্তব্ধ। করোনায় মৃত্যুযন্ত্রণা কঠিন। বেঁচে থাকাটা আরও কঠিন। সারা পৃথিবী যখন করোনা মহামারি নিয়ে চিন্তিত-দুশ্চিন্তিত, তখন এ বিষয়টি খুবই হালকাভাবে নিয়েছে আমাদের গ্রামের মানুষ। সম্ভবত এই চিত্র সারাদেশের প্রায় সব গ্রামের। কে জানে এর ফল কতটা ভয়াবহ হতে চলেছে?
অভিজ্ঞতা বলছে করোনা নানারকম। শহুরে ও গ্রাম্য। সচেতন মহলের করোনা ও অসচেতন মহলের করোনা, বিত্তবানের করোনা ও কুঁড়েঘরের করোনা। মনে হতে পারে, সব ধরনের করোনার মধ্যে গ্রামের করোনা একটু বেশি সহজ-সরল, বোকাসোকা। ঘুরে বেড়াবে কিন্তু কারও ক্ষতি করবে না। ক্ষতি করলেও খুব সামান্য। মৃত্যুর কারণ হবে না। হলেও সেটি ভাগ্যে লেখা ছিল। আমরা সচেতন হয়েও কোনো লাভ নেই। এ বিশ্বাসই গ্রামের অবস্থা ভয়ংকর করে তুলতে পারে। করোনা প্রতিষেধক আবিস্কার না হওয়া পর্যন্ত তাদের আরও সচেতন করতে হবে।
শিক্ষক, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
faruque1712@gmail.com