
ঢাকা: জুলাই মাস বেদনার মাস, শোকের মাস। না, কোনো সরকারিভাবে ঘোষিত শোক বা বেদনার মাস এটি নয়। এই বংলার ঘোরলাগা এক বৃহৎ পাঠক গোষ্ঠীর শোক ও বেদনার মাস জুলাই।
যারা বেহুদা রাজপথে খালি পায়ে হাঁটে, পকেটহীন হলুদ পাঞ্জাবি পরে দিগ্বিদিক ছুটে বেড়ায়, ভরা জোছনায় গৃহত্যাগী হয়, বৃষ্টি দেখলে হয় উন্মাদ, দিন শেষে ক্লান্তির রেশে ঘরে ফিরে মা-বাবার বকা খায়; তাদের জন্যই এ মাসটা বিশেষ কষ্ট ও শোকের। জুলাই তাদের কাছে হারানোর মাস, অশ্রুস্নাত হৃদয় ভাঙার মাস।
কেননা এ মাসেই বাংলা সাহিত্যের ‘রাজপুত্র’ হুমায়ূন আহমেদ না ফেরার দেশে চলে গেছেন। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই যদিও সেদিন নিউইয়র্কের আকাশে লেখকের প্রিয় ‘চান্নি পসর’ রাত ছিল না। তবুও সেদিন না জানি কোন অভিমানে তিনি চির বিদায় নিলেন। রেখে গেলেন তার লেখা অসংখ্য বই, ভক্ত, পাঠক ও বন্ধুজন।
যাবার আগে বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারে অসংখ্য চরিত্রের মধ্যে ‘হিমু’ এবং ‘মিসির আলি’ নামে যে দু’টি চরিত্র রেখে গেলেন তা অবিস্মরণীয়। তার সৃষ্ট এ দু’টি চরিত্রই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে বহুকাল।
তারুণ্যের পাগলামিতে ভরপর হিমুর যাপিত বাউন্ডুলে জীবনের গল্প হাজার বছরের তরুণ সত্তার প্রতিনিধিত্ব করে। যুগে যুগে, কালে কালে নবীনরা হিমুর মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করবে, সুন্দরী রূপাদের উপেক্ষা করার সাহস দেখাবে। কোনো বাঁধনেই বাঁধা না পড়ে নিজের মতো সামনে এগিয়ে যাবে।
আবেগ নির্ভর হিমুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তরুণরা বিরহে হাসবে, বেদনায় গাইবে, বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াবে আবার কাউকে করবে বিভ্রান্ত। তারুণ্যমুখী হিমুর এমন উদ্ভুত চরিত্র পৃথিবীর কোনো কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী এড়িয়ে যেতে পারে না, পারবে না, সম্ভব নয়।
হিমুর লাইফস্টাইলকে কোনো কোনো তরুণ নিছক পাগলামি বলে অভিহিত করেছে। আর মনের অজান্তে সে নিজেও ‘হিমুগিরি’ করেছে। হিমুর মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ তরুণ প্রজন্মের মজ্জাগত মনো-রহস্যের শাশ্বত চিত্রই প্রাণবন্তভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। যা বাংলা সাহিত্যে বিরল।
যাহোক, আপনি যদি হিমুর এসব ছেলেমি পছন্দ না করেন। বুদ্ধিদীপ্ত, যৌক্তিক ও বিজ্ঞান চেতনায় বিশ্বাসী খুব বেশি বাস্তববাদী মানুষ হন। তবে আপনার হতাশ হবার কিছু নেই। হুমায়ূন আহমেদ তার মিসির আলি চরিত্র নিয়ে আপনার মনোজগতে ঝাঁকুনি দেবেন। ‘আট কুঠুরি নয় দরজা’র আদ্যোপান্ত উদ্ধার করে ছাড়বেন।
সামাজের যাবতীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, ভূত-প্রেতে বিশ্বাস, রহস্য, অলৌকিতা, সৃষ্টির রহস্য-বৈচিত্র্য সব কিছুরই বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা মিলবে মিসির আলির কাছে। এ চরিত্রের মাধ্যমে আদিকাল থেকে সমাজের জ্ঞান পিপাসু বিজ্ঞান মনস্ক মানুষের প্রতিচ্ছবি চিত্রায়িত হয়েছে।
পেশাগত জীবন শুরুর আগে তারুণ্যের ভরে পিছুটানহীন এক জীবনের গল্প হিমুর মাধ্যমে। অন্যদিকে, পরিণত বয়সের উপলব্ধি এবং খাঁটি জীবন দর্শন মিসির আলির মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়েছে। অর্থ্যাৎ আপনি যে ক্যাটাগরি কিংবা যে কোনো বয়সের মানুষ হোন না কেন, হুমায়ূন সাহিত্যের বাইরে যাওয়া কঠিন। লেখক বিশ্বাস করেন আমাদের সবার মাঝেই হিমু ও মিসির আলি সত্ত্বা বাস করে। ক্ষেত্র বিশেষে আমরা অবচেতন মনেই তার প্রমাণ দেই।
তার রচনা সমগ্র সাদামাটা, আনন্দদায়ক ও জনমুখী হওয়ায় তিনি এতো বেশি জনপ্রিয় লেখক হয়ে উঠেছিলেন। এ দেশে বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র পরবর্তী তার মতো জনপ্রিয় লেখক কেউ ছিলেন না। আজও তার জনপ্রিয়তার স্থান কেউ নিতে পারেননি।
হুমায়ূনের জনপ্রিয়তায় সমকালীন অন্য লেখকরা কেউ ঈর্ষান্বিত আবার কেউবা পরশ্রীকাতর হয়ে তার উপন্যাসকে বিদ্রুপ করে ‘অপন্যাস’ বলতেন। তিনি এসব নিয়ে তিলার্ধ মাথা ঘামাতেন না। তিনি নিজের মতো শুধু লিখতেন, আর লিখতেন।
প্রচার বিমুখ এ কথাসাহিত্যিক গল্প, উপন্যাস, নাটক, চলচ্চিত্র, গান সবক্ষত্রেই ইয়ার্কির ছলে মানবদর্শনের গহীন তত্ত্বই উন্মোচন করেছেন। সমাজের নানা অসঙ্গতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে তিলার্ধ কার্পণ্য করেননি।
প্রকাশ্যে নয় তিনি নেপথ্যেই কাজ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। পার্থিব জগতের সব ঝুট-ঝামেলা থেকে মুহূর্তেই নিজস্ব গহীন জগতে ডুব দিতে পারতেন। জনতার মধ্য থেকেই তিনি তার সৃষ্টিতে জনতার বন্দনা করেছেন। জনতা সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘জনতার মধ্যেই আছে নির্জনতা। আমার অনেক অনুসন্ধানের একটি অনুসন্ধান হলো-নির্জনতার অনুসন্ধান।’ সারা জীবন তিনি নির্জনতার অনুসন্ধান করেছেন। মরণের পর নুহাশপল্লীতে চির নিদ্রায় শায়িত হয়ে তিনি সেই নির্জনতার অভিযানই যেন অব্যাহত রেখেছেন।