
ভয়েস অব সাতক্ষীরা ডটকম ডেস্ক :
নেত্রকোণার মো. ওবায়দুল হক ওরফে আবু তাহের ও আতাউর রহমান ননীর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ মামলায় ২৬৮ পৃষ্ঠার রায় ঘোষণা করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নিরস্ত্র মানুষকে অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন, লুটপাট ও অগ্নি সংযোগ এবং হত্যার ছয় অভিযোগ রয়েছে এই দুই আসামির বিরুদ্ধে।
মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিচারপতি আনোয়ারুল হক নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে রায়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।
ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যানের প্রারম্ভিক বক্তব্যের পর বিচারপতি মো. সোহরাওয়ারদী ২৬৮ পৃষ্ঠার রায়ের সার সংক্ষেপ পড়া শুরু করেন।
এই বেঞ্চের অপর সদস্য বিচারপতি শাহিনুর ইসলামও এজলাসে উপস্থিত রয়েছেন।
এর আগে সকাল সোয়া ৯টার পর আসামি তাহের ও ননীকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে প্রিজন ভ্যানে করে ট্রাইব্যুনালে নেওয়া হয়। আদালত কক্ষে নেওয়ার আগে তাদের রাখা হয় ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায়।
রমনা পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার (পেট্রোল) এসএম ইমানুল হক বলেন, এই রায় ঘিরে যে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা এড়াতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরুর পর এটি হবে দ্বাবিংশতম রায়।
গতবছর ২ মার্চ অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধাপরাধ মামলার বিচার শুরু হয় ট্রাইব্যুনালে। দুই পক্ষের যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে আদালত গত ১০ জানুয়ারি মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) রাখে।
প্রসিকিউশনের পক্ষে মোট ২৩ জন জবানবন্দি উপস্থাপন করেন। অন্যদিকে আসামিপক্ষ একজন সাফাই সাক্ষীর নাম দিলেও তাকে তারা হাজির করতে পারেনি।
প্রসিকিউটর বাদল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আসামিদের বিরুদ্ধে আনা ছয় অভিযোগের মধ্যে পাঁচটিতে ১৫ জনকে হত্যার দায়ে দুই আসামির সর্বোচ্চ সাজা আশা করছি আমরা। তবে ষষ্ঠ চার্জের পক্ষে সাক্ষী আনা যায়নি।”
অন্যদিকে আসামিপক্ষের কৌঁসুলি আব্দুস সোবাহান তরফদার বলেছেন, তাহের ও ননী খালাস পাবেন বলেই তার বিশ্বাস।
নেত্রোকোণার মুক্তিযোদ্ধা আলী রেজা কাঞ্চন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১০ সালে ননী ও তাহেরসহ ১২ জনকে আসামি করে থানায় মামলা করলে পরে বিষয়টি ট্রাইব্যুনালে আসে।
২০১৩ সালের ৬ জুন এ দুই আসামির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে প্রসিকিউশনের তদন্ত সংস্থা। এক বছর চার মাস ২৮ দিন তদন্তের পরে ২০১৪ সালের ৫ নভেম্বর দেওয়া হয় ৬৩ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন।
প্রসিকিউশনের আবেদনে আদালত পরোয়ানা জারি করলে ওইবছর ১২ অগাস্ট দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করে নেত্রকোণার পুলিশ। পরদিন তাদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করে পাঠানো হয় কারাগারে।
প্রসিকিউশন এ মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের পর ২০১৪ সালের ১১ ডিসেম্বর দুই আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল। এরপর গতবছর ২ মার্চ এ মামলায় অভিযোগ গঠন হয়।
ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাহের ও ননী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে সহযোগিতা করতে গঠিত রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় নেত্রকোনা জেলা সদর ও বারহাট্টা থানাসহ বিভিন্ন এলাকায় মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য তারা ‘কুখ্যাত রাজাকার’ হিসেবে পরিচিতি পান বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।
এদের মধ্যে তাহের স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে ননীসহ অন্যান্য রাজাকার সদস্যদের নিয়ে নেত্রকোনা শহরের মোক্তার পাড়ার বলয় বিশ্বাসের বাড়ি দখল করে রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করেছিলেন বলে প্রসিকিউশনের তথ্য।
প্রথম অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ১৭ অগাস্ট আসামিরা রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনা সদস্যদের নিয়ে নেত্রকোণা থেকে গিয়ে নদী পার হয়ে বারহাচ্চার বাউসী বাজারে হামলা করে। সেখানে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকার সদস্যরা নিরস্ত্র মানুষকে আটক করে নির্যাতন চালায়। আটকদের মধ্যে অনেককে ছেড়ে দেওয়া হলেও বাউসী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মফিজ উদ্দিন তালুকদারের ছেলে ফজলুর রহমানকে তারা আটক রাখে। লুটপাট চালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় বাজারের চার থেকে পাঁচশ দোকান। বাজারের পাশে হিন্দু অধ্যুষিত সাহা পাড়ায় গিয়েও তারা ২০/২৫টি বাড়িতে লুটপাট চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে।
পরে ফজলুর রহমানকে নেত্রকোণায় নিয়ে গিয়ে জেলা পরিষদ ডাক বাংলোয় আটক রেখে নির্যাতন চালানো হয়। ওই রাতে তাহেরের নেতৃত্বে ননী ও তার রাজাকার সঙ্গীরা ফজলুর রহমানকে ত্রিমহোনী ব্রিজে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে এবং লাশ নদীতে ফেলে দেয়।
এ ঘটনায় হত্যা, আটকে রেখে নির্যাতন, দেশত্যাগে বাধ্য করা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে।
দ্বিতীয় অভিযোগ: মোহনগঞ্জ থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার মোশাররফ হোসেনের ছেলে দবির হোসেন একাত্তরে ছিলেন মোহনগঞ্জ পাইলট স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর তিনি মোহনগঞ্জ লুহিয়ার মাঠে (বর্তমানে আলী উসমান শিশু পার্ক) পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে পাকিস্তানপন্থিদের রোষানলে পড়েন।
একাত্তরের ৪ অক্টোবর তাহেরের নেতৃত্বে ননী ও তার রাজাকার সঙ্গীরা বারহাট্টা রোডের নরসিংহ জিউর আখড়া এলাকায় হামলা চালিয়ে দবিরকে আটক করে এবং নির্যাতন চালানোর জন্য জেলা পরিষদের ডাক বাংলোয় নিয়ে যায়। ওই রাতেই দবির হোসেনকে মোক্তারপাড়া ব্রিজে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং এরপর তার লাশ নদীতে ফেলে দেয় আসামিরা।
এ ঘটনায় হত্যা, অপহরণ ও আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে।
তৃতীয় অভিযোগ: একাত্তরের ১৯ অক্টোবর তাহেরের নেতৃত্বে ননী ও স্থানীয় রাজাকার সদস্যরা পাকিস্তানি সেনা সদস্যদের নিয়ে আছমা ইউনিয়নে হামলা চালিয়ে চানফর আরী ও ঋষি মিয়াকে আটক করে নির্যাতন চালায়। পরে তাদের সঙ্গে নিয়ে তারা লাউফা গ্রামে হামলা চালায় এবং সেখানে কয়েকজন নারীকে ধর্ষণ করে সোনার গয়না ছিনিয়ে নিয়ে যায়। আসামি তাহের ও ননীসহ রাজাকার সদস্যরা স্থানীয় মশরব আলীর স্ত্রী নুরু নাহার আক্তারের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। ওই ঘটনায় নুরু নাহার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।
আসামিরা পরে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনা সদস্যদের নিয়ে লাউফা গ্রামের পশ্চিম পাড়ায় হামলা করে। সেখানে ৫০/৬০টি বাড়িতে লুটপাট চালিয়ে আগুন দেওয়া হয়। গ্রামে ছেড়ে যাওয়ার পথে রুজ আলী তালুকদার ও জাফর আলী তালুকদারকে গুলি করে হত্যার পর লাশ খালের পাড়ে ফেলে রাখে আসামিরা।
তারা পরে ওই গ্রাম থেকে বেশ কয়েকজনকে ধরে ঠাকুরকোনা রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ওই রাতেই মশরব আলী তালুকদার, আলাউদ্দিন, জাহেদ আলী, আ. জব্বার, ঋষি মিয়া, চানফর আলীকে ঠাকুরকোনা রেল ব্রিজের নিচে নিয়ে গুলি করা হয়। চানফর গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচাতে পারলেও বাকিদের মৃত্যু হয়।
এ ঘটনায় হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে।
চতুর্থ অভিযোগ: মে মাসের শেষ দিকে তাহেরের নেতৃত্বে ননী ও তাদের রাজাকার সঙ্গীরা মোক্তারপাড়ায় মলয় বিশ্বাসের বাড়ি দখল করে রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করে। মলয় বিশ্বাস ও তার পরিবারের লোকজন প্রাণের ভয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হন। এর ধারাবাহিকতায় নেত্রকোণা শান্তি কমিটির সহ-সভাপতি নেজামী ইসলাম পার্টির তখনকার সভাপতি মাওলানা মঞ্জুরুল হক রাজাকার সদস্যদের নিয়ে অ্যাডভোকেট শ্রীশ চন্দ্র সরকারের বাড়ি দখল করে পার্টির অফিস বসায়। শ্রীশ চন্দ্র ও তার পরিবারও দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।
এ ঘটনায় নির্যাতনের মাধ্যমে দেশ ত্যাগে বাধ্য করার অভিযোগ আনা হয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে।
পঞ্চম অভিযোগ: একাত্তরের ১৫ নভেম্বর দুই আসামি রাজাকার সদস্যদের নিয়ে বিরামপুর বাজারে হামলা চালায় এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বদিউজ্জামান মুক্তাসহ ছয় জনকে অপহরণ করে নেত্রোকোণা ডাকবাংলোর ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন চালায়। পরে আটক সবাইকে খোলা জিপে নিয়ে পুরো শহর ঘোরানো হয় এবং রাতে মোক্তারপাড়া ব্রিজে নিয়ে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। এই হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর আসামিরা উল্লাস করে।
এ ঘটনায় আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা এবং আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
ষষ্ঠ অভিযোগ: একাত্তরের অক্টোবরে আসামিরা নেত্রোকোণা শহর থেকে ১৫ জন হিন্দুকে ধরে ত্রিমোহিনী ব্রিজে নিয়ে যায়। সেখানে গুলি করে তাদের কথ্যা করা হয়।
একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে এই পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞের জন্য আসামিদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে এ ঘটনায়।