
মুক্তিযুদ্ধের বীরোচিত স্মৃতি দেবহাটার টাউন শ্রীপুর গ্রাম। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ শ্রী সতীশ চন্দ্র মিত্রর ভাষায় ‘ইচ্ছামতি’ (ইছামতি) নদী তীরের এই গ্রামে ৭১ এ গর্জে উঠেছিল রাইফেলের ভাষায় মুক্তির সনদ। মাত্র ৩৫ মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে এই গ্রামে হানাদার পাকি বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে দিয়ে বাংলার ঢেউ খেলানো গ্রাম টাউন শ্রীপুরকে নিজেদের কাছেই আঁকড়ে রেখেছিল বীর যোদ্ধারা।
আর এর নেতৃত্বে ছিলেন টাউন শ্রীপুরের মাটিতে বেড়ে ওঠা বীর পুরুষ শাহজাহান মাস্টার। যিনি ছিলেন ছাত্রদের মাস্টার , মুক্তিযোদ্ধাদের মাস্টার, সমাজের পদপ্রদর্শক মাস্টার। টাউন শ্রীপুরে ৭১ এর ৬ জুন সংঘটিত সম্মুখযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী শাহজাহান মাস্টার ।
টাউন শ্রীপুর যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কমপক্ষে ২৩ জন সৈনিক মুক্তিযোদ্ধাদের বন্দুকের গুলিতে নিহত হলেও শহীদ হয়েছিলেন সাত মুক্তিযোদ্ধা। আর সেই ইতিহাসের রচয়িতা শাহজাহান মাস্টার। ইছামতির নদীর জল সেদিন বাংলার দামাল ছেলেদের রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল।শাহজাহান মাস্টারের সেই স্মৃতির সাথে এখনও যেনো রক্তের দাগ মিলে মিশে আছে।
প্রয়াত শাহজাহান মাস্টারের কথা বলতে গেলেই মনে আসবে একাত্তরে সাতক্ষীরার সবচেয়ে বড় যুদ্ধ টাউন শ্রীপুর যুদ্ধের কথা।
জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত মানুষের কল্যাণ কাজ করে গেছেন তিনি। দেশ মাতৃকার স্বাধিকার অর্জনে অনুপ্রাণিত সেদিনের সেই স্কুল শিক্ষক ৭১ এ মসি ফেলে হাতে তুলে নিয়েছিলেন অসি। আর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে । গড়ে তুলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের নবম সেক্টর।
মহান মুক্তিযুদ্ধে নবম সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার শাহজাহান মাস্টার এভাবেই অর্জন করেছিলেন সম্মানজনক বীরোচিত উপাধি ক্যাপ্টেন।
আজ সেই ২৩ জুলাই। ১৯৯৩ এর এই দিনে স্কুল কক্ষে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তার জীবন বায়ূ নিঃশেষ হয়ে যায়। সমাপ্তি ঘটেছিল দক্ষিন বাংলার অকুতোভয় শার্দুলের । ছাত্রজীবনে কখনও রাজনীতি করেন নি তিনি।
১৯৩৮ এর ৬ ফেব্রুয়ারি জন্মের পর প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েছিলেন গ্রামের মক্তবে। পরে টাউন শ্রীপুর শরচ্চন্দ্র হাইস্কুলে। সাতক্ষীরা কলেজ থেকে আইএ পাস করার পর কুষ্টিয়া কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। পরে বিএড করেন ঢাকা থেকে। এরপরই যোগ দেন শিক্ষকতার পেশায়।
শ্যামনগরের হরিনগর সুন্দরবন হাইস্কুলের সহকারি শিক্ষক হিসাবে কাজ করেন তিনি। পরে শাকরা কোমরপুর এবং তারও পরে টাউনশ্রীপুর হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার। জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত তিনি ছিলেন সখিপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। এভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন মানুষ গড়ার খাঁটি কারিগর।
মুক্তিযুদ্ধের কিছুদিন পর তাকে ধরে নিয়ে আটকে রাখা হয় অজ্ঞাত স্থানে। ১৮ দিন তিনি ছিলেন পরিবারের কাছে নিখোঁজ। পরে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় ভোমরা সেনাক্যাম্পে। সেখানে তার ওপর চালানো হয় নির্যাতন। পরে তাকে জেলে পাঠানো হয়। বন্দী ছিলেন প্রায় দেড় মাস।
তার মুক্তির জন্য সাতক্ষীরার সাবেক সাংসদ মুনসুর আহমেদ ও পারুলিয়ার আশরাফ সরদার সরাসরি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে যান শেখ ফজলুল হক মনিকে নিয়ে। বঙ্গবন্ধুকে তারা জানান মুক্তিযুদ্ধে শাহজাহান মাস্টারের বীরোচিত ভূমিকার কথা।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাকে তাৎক্ষনিক মুক্তি দেওয়া হয়। প্রায় দেড় মাস কারাবরন শেষে সাতক্ষীরা জেল থেকে মুক্তি পাবার সাথে সাথে তাকে নিয়ে আসা হয় প্রয়াত নেতা সাংসদ সৈয়দ কামাল বখত সাকির বাড়িতে। কারামুক্তি মাত্র কয়েকদিন আগে অন্তরীন থাকাকালে তিনি ১৯৭২ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন।
১৯৭৩ এর প্রথম সংসদ নির্বাচনে জাসদের প্রার্থী হিসাবে আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা এড. এফএম এন্তাজ আলির সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর পর থেকে তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন জাসদের কেন্দ্রীয় সদস্য ও এক সময় সহ সভাপতি ছিলেন।
সাতক্ষীরা জেলা জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও ছিলেন শাহজাহান মাস্টার। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনাবলীর পর শাহজাহান মাস্টার তালার মুড়োগাছা এলাকা থেকে গ্রেফতার হন। মোশতাক সরকারের পুলিশ তাকে লক্ষ্য করে খুব কাছ থেকে গুলি করে। গুলিতে তার তার ডান পা ও তার ঘনিষ্ট সহকর্মী জাসদের এড.আবুবকর সিদ্দিকের ডান পা জখম হয়।
আহত হন আরও এক সহযোগী ইউপি চেয়ারম্যান জালাল ঢালি ও জাসদ নেতা আবদুস সালাম। ১৯৭৫ এর ২ অক্টোবরের এ ঘটনার পর থেকে টানা পাঁচ বছর ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার কারাবন্দী ছিলেন।
১৯৭৯ এর প্রথম দিকে তার মুক্তি মেলে। মুক্তিলাভের পর তিনি ফের যোগ দেন শিক্ষকতার পেশায়। ১৯৭৯ এর সংসদ নির্বাচনে প্রয়াত বিএনপি নেতা সাবেক বস্ত্রমন্ত্রী এড. এম মনসুর আলির বিপক্ষে আবারও অংশ নেন তিনি। ব্যক্তি জীবনে একজন সৎ ও জনদরদী শাহজাহান মাস্টার ১৯৮৫ এর প্রথম উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হন দেবহাটা উপজেলা চেয়ারম্যান।
এ সময়কালে তিনি সমাজের দুঃস্থ মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। সমসাময়িক রাজনৈতিক আন্দোলনেও তিনি সব সময় পালন করেছেন অগ্রনী ভূমিকা। সাতক্ষীরা তথা দক্ষিন বাংলার সকল রাজনৈতিক ও সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তিনি একাত্ম হয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে অক্লান্ত ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। একজন কীর্তিমান পুরুষ হিসাবে নিজেকে সকল বিতর্কের উর্ধ্বে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। প্রগতিশীল রাজনীতির পথপ্রদর্শক, গনতন্ত্রের সেবক ,দুঃস্থ মানুষের সাথী শিক্ষাব্রতী ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার দলমত নির্বিশেষে সকলেরই ‘শাহজাহান স্যার’ হিসাবে আজও সম্মানিত সমাদৃত।
মাতৃভূমির প্রতি প্রেম থাকে যে সন্তানদের হৃদয়জুড়ে , মৃত্যু তাদের কখনও ছোঁয়না। ছুঁতে পারেনা। যুগে যুগে বিপ্লবীরা এমনই হন। যেমন মাস্টারদা সূর্য সেন ও ক্ষুদিরাম। মুক্তির জন্য তারা হাসিমুখে দিয়েছেন প্রাণ। তেমনি এই জনপদের শাহজাহান মাস্টার ভয়হীন চিত্ত বার বার আলিঙ্গন করেছে মৃত্যুকে। জীবন উৎসর্গ করেছেন দেশ ও জাতির মুক্তির স্বপ্নে।
এখনও ২৩ জুলাইয়ের এই দিনে টাউন শ্রীপুর শরচ্চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের শ্যামল সবুজ চত্বরে চিরনিদ্রিত শাহজাহান মাস্টারের সমাধি স্পর্শ করে সালাম জানায় তার অনুসারী, ভক্ত, শুভানুধ্যায়ী ও মুক্তিযোদ্ধা জনতা।
——- সুভাষ চৌধুরী , সাংবাদিক , দৈনিক যুগান্তর ও এনটিভি।
##