
অনলাইন ডেস্ক :
যুক্তরাজ্যের পূর্ব লন্ডনের ব্রিক লেনে বাংলাদেশি শাক-সবজি, মাছ, মসলার প্রথম দোকান ‘তাজ স্টোরস’। আসছে আগস্টে এই মুদিখানা ৮০ বছর পূর্ণ করবে।
বৃহস্পতিবার বিবিসি বাংলা অনলাইনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্রিটেনে বাংলাদেশিদের ইতিহাস লেখা হলে হয়তো ‘তাজ স্টোরসের’ নাম থাকতেই হবে।
ব্রিটেনে প্রথম বাংলাদেশি মুদিখানার ৮০ বছর
পূর্ব লন্ডনের ব্রিক লেনে ‘তাজ স্টোরস’—সংগৃহীত
”তাজ স্টোরসের’ বর্তমান কর্ণধার জামাল খালিক এক সাক্ষাৎকারে বিবিসিকে জানিয়েছেন, ৮০ বছর আগে তার বড় চাচার হাতে এই মুদিখানার পত্তন ও প্রসার, ব্রিক লেনে তার ছেলেবেলা ও বেড়ে ওঠা ইত্যাদি নানা বিষয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জামাল খালিকের বড় চাচা আব্দুল জব্বার কাজ করতেন ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে। তিরিশের দশকে তিনি যে জাহাজে কাজ করতেন সেটি ইংল্যান্ডের একটি বন্দরে নোঙর করার পর সেখানে নেমে গিয়েছিলেন। তারপর ঘুরতে ঘুরতে পূর্ব লন্ডনে আসেন তিনি।
জামাল খালিক বলেন, ‘সে সময় পূর্ব লন্ডন থাকতেন ইহুদি ও আইরিশরা। অনেক চামড়া ও পোশাকের কারখানা ছিল। বছর দুয়েক আমার চাচা কারখানায় কাজ করেছেন।’
তাজ স্টোরসের পেছনে আইরিশ নারী
পূর্ব লন্ডনে যাওয়ার কিছুদিন পর আব্দুল জব্বারের সঙ্গে পরিচয় হয় আইরিশ এক তরুণী ক্যাথলিনের। তারপর প্রেম থেকে পরিণয়।
ব্রিটেনে প্রথম বাংলাদেশি মুদিখানার ৮০ বছর
১৯৭৮ সালে তাজ স্টোরস—বিবিসি বাংলা
এ প্রসঙ্গে জামাল খালিক বলেন, ‘আমার সেই আইরিশ আন্টি খুবই ভালোবাসতেন আমার চাচাকে। তিনিই ব্রিক লেনে ছোটো একটি মুদিখানার দোকান খুলে দেন। সেটি ১৯৩৬ সালের কথা।’
‘তাজ স্টোরসের পেছনে আমার সেই আন্টির অবদানই বেশি।’
আলু, পেঁয়াজসহ স্থানীয় আইরিশ ও ইহুদিদের প্রয়োজনীয় পণ্য প্রথম প্রথম বিক্রি হতো সেখানে। সত্তরের দশকে ব্রিক লেন ও আশপাশের এলাকায় বাংলাদেশিরা বসবাস শুরুর পর থেকে বাংলাদেশ থেকে শাক-সবজি, মাছ, মসলা আনা শুরু করে ‘তাজ স্টোরস’।
তবে এখন ‘তাজ স্টোরসে’ বাংলাদেশ থেকে আনা বেগুন, শিম, চিচিঙ্গা ছাড়াও বিক্রি হয় আরও বহু দেশের পণ্য।
প্রতিষ্ঠানটির দ্বিতীয় প্রজন্মের কর্ণধার জামাল খালিক বলেন, ‘বলতে পারেন তাজ স্টোরস এখন আন্তর্জাতিক একটি সুপার মার্কেট।’
নোংরা, অন্ধকার ব্রিক লেন
ব্রিক লেনে জন্ম ও বেড়ে ওঠেছেন জামাল খালিক। ৪৫ বছর ধরে সেখানেই রয়েছেন।
তার ভাষায়, ‘এখন যে সুন্দর ঝকঝকে ব্রিক লেন দেখছেন, আমার ছেলেবেলায় তা ছিল না। নোংরা, গন্ধ, অন্ধকার…। প্রতি রোববার ন্যাশনাল ফ্রন্টের (বর্ণবাদী দল) লোকজন এসে হামলা করতো। বোতল, পেট্রোল বোমা ছুড়তো।’
তাজ স্টোরের ওপর তলায় পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে থাকতেন জামাল। তিনি বলেন, ‘ভয়ে থাকতাম। যদি ওরা উঠে আসে, সেজন্য আমরাও বোতল, লাঠি জড় করে রাখতাম।’
শাহরুখ খানের সূত্রে বাংলাদেশে বিনিয়োগ
‘তাজ স্টোরস’ থেকে ব্যবসা অনেক বাড়িয়েছেন জামাল খালিক ও তার ভাইয়েরা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খুলেছেন। বাংলাদেশে এনআরবি ব্যাংক নামে বেসরকারি একটি ব্যাংকের একজন অংশীদার তিনি।
বাংলাদেশে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জামাল খালিক বলেন, ‘এটা হয়েছে শাহরুখ খানের সূত্রে। বলিউডের এই তারকার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক কুড়ি বছরেরও পুরনো।’
২০১০ সালে ঢাকায় এক কনসার্টে যাওয়ার সময় শাহরুখ খান জামাল খালিককে সঙ্গে যাওয়ার অনুরোধ করেন।
তিনি বলেন, ‘শাহরুখ যখন বড় তারকা হননি তখন লন্ডনে তার সঙ্গে পরিচয়। লন্ডনে এলেই তিনি আসতেন আমাদের দোকানে। এখনও নিয়মিত যোগাযোগ আছে।’
জামালা আরও বলেন, ‘আমাদের পৈত্রিকভিটে মৌলভিবাজারে। ছোটবেলায় মাঝে মধ্যে যেতাম, কিন্তু বাংলাদেশে কোনা বন্ধু ছিল না। সেই প্রথম ঢাকায় গিয়ে কিছু বন্ধু হলো। তখনই বাংলাদেশে এমন কিছু করতে ইচ্ছা হলো, যাতে নিয়মিত একটা যোগাযোগ রাখা যায়।’
কিন্তু নির্মাণ কোম্পানির মালিক হোন, আর ব্যাংকের মালিক হোন, জামাল খালিক বলন, তাজ স্টোরসের জন্য তার টান সবচেয়ে বেশি। এজন্য লন্ডন থাকলে প্রতিদিনই তাকে দোকানে দেখা যায়।
তার ভাষায়, ‘যা কিছুই করেছি, তাজ স্টোরস থেকেই। ছোটবেলায় স্কুল থেকে আসার পর বাবার সঙ্গে দোকানে ঝাড়পোছ, জিনিস সাজানোর কাজ করতাম। খুব ভালো লাগতো। কাস্টমারদের সঙ্গে প্রতিদিন মুখোমুখি দেখা, কথা–এগুলো খুবই ভালো লাগে।’
আশি বছর হলো, আর কতদিন থাকবে তাজ স্টোরস—হাসতে হাসতে জামাল খালিক বলেন, ‘অন্তত একশ’ বছর পূরণ করবো, ইনশাল্লাহ।’