
মহাবিজয়ের ৪৭ বছর পরও একাত্তরের রক্তঝরা দিনগুলির কথা এতোটুকুও ভুলিনি। বীর বাঙ্গালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো সেই অগ্নিঝরা স্লোগান এখনও কানে বাজে । নিরস্ত্র জনগনের ওপর হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর উপর্যুপরি হামলায় শহীদ ভাই বোনদের কথা কি কখনও ভুলা যায়। গনহত্যা বাড়িঘর লুন্ঠন অগ্নিসংযোগ নারীর ওপর অমানবিক নির্যাতনের সে সব দৃশ্য যারা না দেখেছেন তাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হতেই পারে। তবে যে বিশ্বাসটি তারা ধারন করেছেন সেটি হলো বাংলাদেশের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী একমাত্র বাঙ্গালি। আর বাঙ্গালি তার স্বাধিকার আদায় করেছে মাঠে রণাঙ্গনে লড়াই করে , রক্ত দিয়ে। স্বাধীনতা কারও দয়ার দান নয়, বাঙ্গালির শ্রেষ্ঠ অর্জন এই স্বাধীনতা।
২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙ্গালির ওপর সমুদয় শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনী। তারা বঙ্গবন্ধুকে আটক করে নিয়ে গিয়েছিল অজ্ঞাত স্থানে। তার ওপর চাপ প্রয়োগ করে নানা প্রলোভন দেখানো হয়েছিল। কিন্তু ঘৃণাভরে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের মতো শক্তি ও সাহস দেখিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি ডাক দিয়েছিলেন স্বাধীনতার, ঘোষনা দিয়েছিলেন স্বাধীনতার, জাতিকে আহবান করে বলেছিলেন তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। এবারের সংগ্রাম , স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।
আমরা ছাত্রাবস্থায় বঙ্গবন্ধুর এই জ্বালাময়ী বক্তৃতায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম, নিজেদের রক্তে বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ অনুভব করেছি। ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ দেশপ্রেমমূলক গানে প্রাণ ফিরে পেয়েছিলাম। গ্রামে থেকেও উজ্জীবিত হয়ে নিজেরা সংগঠিত হয়েছি। দলে দলে আমরা মুক্তি পাগল বীর জনতার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছি মুক্তিযুদ্ধে। পািকস্তানি শত্রু হননের শক্তি ও সাহস সঞ্চার করেছি।
১৯৭১ এর ২৬ মার্চ তৎকালিন পাকিস্তানের সামরিক শাসকচক্র যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল বাঙ্গালির ওপর, নয় মাসব্যাপী সেই যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর ৭১ এ জাতি পৃথিবীর মানচিত্রে এঁকে দিতে সক্ষম হয়েছে নতুন এক রাষ্ট্রের সীমানা, একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। পৃথিবী স্বীকার করে নিল বঙ্গোপসাগর বিধৌত বাংলাদেশ নামের ভূখন্ডটি এখন থেকে শাসন করবে বাঙ্গালিরাই। সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হবে একমাত্র বাঙ্গালিই।
সাতক্ষীরা জেলায় ( তৎকালিন মহকুমা ) মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সোপানটি ছিল খুবই তাৎপর্যময়। এখানকার দামাল ছেলেরা ব্যাতিক্রমী ও অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ইতিহাসে স্মরিত হয়েছেন। পাকিস্তানি পতাকায় অগ্নিসংযোগ, সাতক্ষীরা ট্রেজারি থেকে অস্ত্র লুঠ, পাঞ্জাবি এসডিওকে বন্দী এবং ন্যাশনাল ব্যাংক অপারেশনের মতো দুঃসাহসিক অভিযান মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনা ঘটিয়েছিল সাতক্ষীরায়।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষনার পর তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানে কেবলমাত্র সামরিক ছাউনি এবং আধা সামরিক কিছু ক্যাম্পে ছাড়া অন্য কোথাও পাকিস্তানি পতাকা উড়তে দেখা যায়নি। বরং ২৩ মার্চের পর সর্বত্র দেখা গেছে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা। এ সময় পাকিস্তান বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল আসগর খান পূর্ব পাকিস্তান সফর শেষে করাচি বিমান বন্দরে নেমে সাংবাদিকদের বলেন কেবলমাত্র ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া অন্য কোথাও পাকিস্তানি পতাকা তার চোখে পড়েনি। জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে এ খবর ছিল ভীষন এক দুঃসংবাদ। কিন্তু সাতক্ষীরার ক্ষেত্রে ঘটেছিল ভিন্ন ঘটনা। এখানে সে সময়কার এসডিও ছিলেন পাঞ্জাবি খালেদ মাহমুদ সিএসপি। তার অফিসে তখনও উড়ছিল পাকিস্তানি পতাকা। দেশের কোথাও নেই কেবল পাঞ্জাবি এসডিওর অফিসে পাকিস্তানি পতাকা উড়বে সাতক্ষীরার ছেলেরা তা মেনে নিতে পারেনি। সিদ্ধান্ত হলো পতাকা নামিয়ে পুড়াতে হবে। সেদিন ছিল ২৯ মার্চ। দেশব্যাপী হানাদার বাহিনীর গনহত্যা শুরু হয়েছে আগেই। সেই উত্তাল দিনে ছাত্রনেতা আবদুস সালাম ,কামরুল ইসলাম খান , মীর মোস্তাক আহমেদ রবি, এনামুল হক , আজিবর রহমান , মোস্তাফিজুর রহমানসহ একদল উদ্যমী ছাত্র নেতা এসডিও অফিসের সামনে হাজির হলেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বীরদর্পে কামরুল ইসলাম উঠে গেলেন ছাদে। নিমেষেই পতাকা নামিয়ে আনলেন । এরপর সকলে মিলে আগুন ধরিয়ে দিলেন চাঁদ তারা খচিত পাকিস্তানি পতাকায়। এসডিও ভবনে উড্ডীন হলো বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা।
জেলা শহর খুলনা ততদিনে পাকিস্তানি মিলিটারিদের নিয়ন্ত্রনে চলে গেছে। যেকোনো সময় তারা পৌঁছাবে সাতক্ষীরা মহকুমায়। প্রতিহত করতে হবে তাদের। যুদ্ধ দামামা বাজার এই মুহুর্তে সাতক্ষীরা পৌঁছালেন পাইকগাছা কয়রা আশাশুনি আসনের এমএনএ আবদুল গফুর। তিনি বললেন সারা দেশে সংগ্রাম পরিষদের ডাকে বাংলার মানুষ বীরোচিতভাবে পাকিস্তানিদের প্রতিহত করছে। আমরাও মোকাবেলা করতে চাই। এমএনএ গফুরের এই অনুপ্রেরনায় ছাত্র জনতা সমস্বরে বললেন অস্ত্র চাই , সেই অস্ত্র দিয়ে হায়েনার দলকে আমরা রুখে দিতে চাই। তাৎক্ষনিকভাবে এমএনও আবদুল গফুর এবং ইপিআর সুবেদার আইয়ুব আলি চলে গেলেন বাঙ্গালি এসডিপিওর সাথে কথা বলতে। ওই সময়কার খুলনার এসপি একে খোন্দকার আগেই পুলিশ বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন গোপনে সংগ্রাম পরিষদের সাথে কথা বলে বাঙ্গালি জাতির মুক্তির লক্ষ্যে কাজ করতে। আলাপ হতেই এসডিপিও সম্মতি দিয়ে বললেন সাতক্ষীরা ট্রেজারির সব অস্ত্র নিয়ে নিতে। তার এই সাহসী এবং উদার সহযোগিতার কারণে ওই দিনই লুট করা হলো ট্রেজারির ৩৫০ টি ৩০৩ রাইফেল ও ৩০-৪০ বাক্স গুলি। মোস্তাফিজুর রহমান, কামরুল ইসলাম খান, মাসুদ হোসেন , এনামুল হক, এরশাদ খান হাবলুর মতো তরুন নেতা অস্ত্র ও গোলা বারুদ হাতে তুলে মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার দৃপ্ত শপথ গ্রহন করেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সোপানের এই দিনগুলিতে সাতক্ষীরার ভোমরায় গড়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি প্রশিক্ষন ক্যাম্প। শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দুরের এই ক্যাম্পের বিপরীতে পশ্চিম সীমান্তে ভারতের বসিরহাট মহকুমা। ভোমরা কাস্টমস ও ইপিআর ক্যাম্প জুড়ে শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষন। বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা এতে যোগ দেন। তখনও মুক্তিযুদ্ধের কোনো সেক্টর গড়ে ওঠেনি। এমএনএ গফুর ও ইপিআর সুবেদার আইয়ুব আলি প্রশিক্ষনে নেতৃত্ব দেন। এই ক্যাম্পে বসে তরুন মুক্তিযোদ্ধারা জানতে পারেন সাতক্ষীরার পাঞ্জাবি এসডিও খালেদ মাহমুদ ভীত হয়ে সাতক্ষীরার মুসলিম লীগ নেতা আবদুল গফুরের বাড়িতে পালিয়েছেন। এ খবর পেয়ে সুবেদার আইয়ুব এক গাড়ি ইপিআর সদস্য নিয়ে চলে আসেন তার বাড়িতে। তারা চাপ দেন এসডিওকে বের করে দিতে। কিন্তু আবদুল গফুর তাকে হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানান । অবশেষে আবুদল গফুরের পুত্রবধূ এসডিও খালেদ মাহমুদকে বের করে দেন একটি তালাবদ্ধ বাথরুম থেকে। তাদের হাতে বন্দী এসডিওকে নিয়ে তরুন মুক্তিযোদ্ধারা আসেন ভোমরা ক্যাম্পে। পরে তাকে হস্তান্তর করা হয় ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে।
ভোমরা প্রশিক্ষন ক্যাম্পে অস্ত্র গোলাবারুদ থাকলেও সংকট দেখা দেয় খাদ্যের। এজন্য কোনো ব্যাংক থেকে অর্থ সংগ্রহ করার প্রস্তাব করেন এমএনএ গফুর। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় ইপিআর সুবেদার আইয়ুব আলির সাথে । তিনি সম্মত হলেন এবং খবর নিয়ে জানলেন সাতক্ষীরাস্থ ন্যাশনাল ব্যাংকে দুই কোটি টাকা ও অনেক স্বর্ন আছে। তারা কথা বললেন রিজার্ভ ফোর্স ও পুলিশের সাথেও । তারা বললেন তারা সহায়তা দেবেন। ২৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় এসডিওর জীপ, ওয়াপদার জীপ ও জনস্বাস্থ্য বিভাগের একটি পিক আপ নিয়ে এমএনও গফুর এবং সুবেদার আইয়ুবের নেতৃত্বে ৩৫- ৪০ জন সশস্ত্র ইপিআর এবং সালাম, মোস্তাফিজ, এরশাদ খান হাবলু, শেখ মাসুদ ,এনামুলসহ ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা চলে এলেন সাতক্ষীরা ন্যাশনাল ব্যাংক গেটে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সিকিউরিটি পুলিশ ও রিজার্ভ ফোর্সকে নিরস্ত্র করে দুই নেতা ঢুকলেন ব্যাংকের মধ্যে । কিন্তু স্ট্রং রুমে তালা দেথে তারা হতবাক । অবশেষে সুবেদার আইয়ুব গেলেন ম্যানেজারকে চাবিসহ ধরে আনতে। এরই মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা তালা ভাঙ্গতে শুরু করলেন। হ্যা´ ব্লেড ব্যবহার করে তালা খুলে জব্দ করা হলো টাকা ও সোনা। ইপিআরের একটি জীপ ভর্তি করে সুবেদার আইয়ুব চলে গেলেন ভোমরায়। তখন ভোর। এতো বিপুল পরিমান টাকা এক সাথে দেখে সবাই অবাক। ৩০ এপ্রিল ওই টাকা তারা জমা দিলেন বসিরহাট এসডিওর কাছে । অবশেষে তা ব্যাংকে জমা করা হলো নবগঠিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নামে। সদ্য গঠিত বাংলাদেশ সরকার এই নগদ টাকা নিয়ে যাত্রা শুরু করলো ।
বাঙ্গালি জাতির স্বাধীনতা অর্জনে স্বল্প সময়ের মধ্যে সাতক্ষীরার এই চার যুগান্তকারী ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্নাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে।
——– সুভাষ চৌধুরী , সাতক্ষীরা করেসপন্ডেন্ট, দৈনিক যুগান্তর ও এনটিভি।