
লোনা পানির আগ্রাসনে সোতা ও সংক্রান্তি খালের উপর নির্ভরশীল সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ি ইউনিয়নের খুঁটিকাটা, কাচিহারানিয়া ও কাঁঠালবাড়ীয়া গ্রামের পাঁচ শতাধিক পরিবারের জীবন-জীবিকা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। খাল দুটিতে মাছ ধরে, খাল থেকে সেচ দিয়ে ফসল উৎপাদন করে ও দৈনন্দিন কাজে খালের পানি ব্যবহার করে জীবন চলত পরিবারগুলোর। কিন্তু প্রভাবশালীরা ইজারা নিয়ে লোনা পানি তুলে মাছ চাষ করায় স্থানীয়দের জীবন-জীবিকা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। মরে যাচ্ছে খাল পাড়ের গাছগুলো। কষ্ট পাচ্ছে পরিবারগুলোয় পালিত গবাদি পশু-পাখিরাও।
স্থানীয়দের দাবি, অবিলম্বে খাল দুটির ইজারা বাতিল ও খালে লোনা পানি উত্তোলন নিষিদ্ধ করে মানুষের জীবন-জীবিকা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হোক।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কাশিমাড়ি ইউনিয়নের খুঁটিকাটা, কাচিহারানিয়া ও কাঁঠালবাড়ীয়া গ্রামে পানির উৎস খাল ও পুকুর। নলকূপে লবণ পানি ওঠায় এখানকার মানুষ পুকুরের পানি পান করে। খালের পানি ব্যবহার করে দৈনন্দিন কাজসহ সেচ দিয়ে উৎপাদনে। খাল দুটি ইজারা দেওয়ায় বিপন্ন এখানকার মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।
খুঁটিকাটা গ্রামের সোতা খাল পাড়ের বাসিন্দা শিবানী মন্ডল বলেন, ‘খালে যখন মিষ্টি পানি ছিল তখন গ্রামে শান্তি ছিল। এখন খালে লবন পানির মাছ চাষ করায় এলাকায় হাহাকার দেখা দিয়েছে। গ্রামে খাবার পানির যেমন কষ্ট, তেমনি সবজি চাষের ভিটেও লোনা হয়ে যাচ্ছে। মরে যাচ্ছে এলাকার গাছপালা। খালটি ৫/৭ জন ভোগ-দখল করে শত শত পরিবারের ক্ষতি করছে। আমরা রাতে চলাচল করতে পারি না। টর্চ লাইট চোখে মারে। খালে পানি নিতে গেলে গালাগালি করে।’
স্থানীয় বাসিন্দা নিশিকান্ত জানান, খালটিতে বর্ষার পানি জমলে গ্রামের কৃষকেরা কৃষি কাজে ব্যবহার করত। স্থানীয়রা খাল থেকে মাছ ধরে ও খালের উপর নির্ভর করে গবাদিপশু-পাখি পালন করত। কৃষকেরা খালের মিষ্টি পানি সেচ দিয়ে আমন ও বোরো মৌসুমে ফসল উৎপাদন করত। দীর্ঘ ২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সোতা খাল সরকার ২০০৯ সালে পুনঃখনন করে। কিন্তু ২০১৩ সালে জনৈক মুজিবর রহমানসহ আরো দুই জন পরস্পর যোগসাজশে সোতা খাল ইজারা নিয়ে লবন পানি তুলে মাছ চাষ শুরু করে। এতে মিষ্টি পানির আধার নষ্ট হওয়ায় সোতা খালের উপর নির্ভরশীল ৩ গ্রামের কৃষি নির্ভর জীবনযাত্রা বিপন্ন হয়ে পড়ে।
একই এলাকার রতিকান্ত বলেন, সোতা খালের সাথে সম্পৃক্ত সংক্রান্তি খালও সরকার ২০০৯ সালে
পুনঃখনন করে। কিন্তু বর্তমানে জনৈক রফিকুল গাজীসহ পাঁচ ব্যক্তি সোতা ও সংক্রান্তি খাল ইজারা নিয়ে লবন পানি তুলে মাছ চাষ করছে। এখন আর গ্রামের কৃষকদের খালের পানি ব্যবহার করতে দেয় না, এমনকি খালের রাস্তায় হাটতেও বাঁধা দেয়। খালে লোনা পানি তোলায় খাল পাড়ের গ্রামের সুপেয় পানির পুকুর, ডোবা, খানা এমনকি বসতভিটার কৃষি জমিও লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। সেচের অভাবে বোরো মৌসুমে ধান লাগাতে পারেনি স্থানীয়রা। খাল সেচে মাছ ধরা শেষ। আবারও লবণ পানি উঠাবে ইজারাদাররা।
এলাকাবাসী জানান, স্থানীয়দের ব্যবহারে উন্মুক্তকরণ ও লবণ পানি উত্তোলন নিষিদ্ধ করে খাল পাড়ের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নিশ্চিতের দাবিতে কর্তৃপক্ষের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কার্যকর কোন পদক্ষেপ এখনো দৃশ্যমান হয়নি।
স্থানীয়রা এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা-৪ আসনের সংসদ সদস্য স ম জগলুল হায়দার ও সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক নাজমুল আহসানের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
এ ব্যাপারে কাশিমাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কোরবান আলী বলেন, খুঁটিকাটা, কাচিহারানিয়া ও কাঁঠালবাড়ীয়া গ্রামে মিষ্টি পানি নেই। মিষ্টি পানি পাওয়া যায় খালে ও পুকুরে। তাও যে বছর বৃষ্টি কম হয়, সেবছর মিষ্টি পানি থাকে না। তাই স্থানীয়দের ব্যবহারের জন্য সোতা ও সংক্রান্তি খাল উন্মুক্ত করে দেয়া উচিত। তা না হলে খাল পাড়ের জীবন-জীবিকা বিপন্ন হবে। এলাকায় হাহাকার বেড়ে যাবে।
বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইনডেজিনাস নলেজের স্থানীয় পরিবেশ গবেষক শাহীন ইসলাম বলেন, লোনা পানি জীববৈচিত্র্যের জন্য সব সময়ই হুমকি। তার উপর খুঁটিকাটা, কাচিহারানিয়া ও কাঁঠালবাড়ীয়া গ্রামে নলকূপের পানি খাওয়া যায় না। সেখানে খাল ও পুকুরই যখন ভরসা, তখন তা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করার বিকল্প নেই। শুধু উন্মুক্ত করলেই চলবে না, লবণ পানি ওঠানো বন্ধ করতে হবে। তাহলেই জীববৈচিত্র্যের সুরক্ষা হবে।
এ ব্যাপারে স্থানীয় সংসদ সদস্য স.ম জগলুল হায়দার বলেন, সুতার খাল ইজারা দেওয়ার বিষয়টি তিনি জানতেন না। বিষয়টি নিয়ে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যস্থা করা হবে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক নাজমুর আহসান বলেন, বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাা গ্রহন করা হবে। প্রয়োজনে ইজারা বাতিল করা হবে।