
নাজমুল হক :
ভয়াবহ রূপ নিতে যাচ্ছে জেলার জলাবদ্ধ পরিস্থিতি। ভারী বর্ষনে পুরো সাতক্ষীরাকে যেন চারিদিক থেকে প্রায় গ্রাস করে ফেলছে। বিশেষ করে কপোতাক্ষ ও বেতনা নদী দিয়ে বর্ষার পানি নিস্কাশন না হওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তার পরে যোগ হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ নদী ও খালে বাঁধ,নেট ও পাটা। দ্রুত পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা না করা হলে এবছর সাতক্ষীরার ২২ লাখ মানুষের ভাগ্যে চরম দুর্ভোগ নেমে আসবে বলে আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা। তারা বলছে, শেখ হাসিনা সরকার সাতক্ষীরার পানি নিস্কাশনে, বিশেষ করে কপোতাক্ষ নদ ও বেতনা নদী খননে যে পরিমান টাকা বরাদ্দ দিয়েছে তা যদি মহা লুটপাট না হতো তাহলে আজ ভয়াবহ এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।
গত কয়েক দিনে টানা বর্ষনে প্রত্যেকটি বিলের পানি বৃদ্ধির খবর পাওয়া গেছে। নদী ও খালে কোথাও কোথাও ৩ থেকে ৪ ফুট পানি বৃদ্ধি পয়েছে। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বিভিন্ন বিলে অবৈধ নেট-পাটা অপসারণ কার্যক্রম শুরু হলেও বর্ষার কারণে তা তেমন কোন কাজে আসছে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তারা জানান খাল দখল, বিলে লোনা পানি উত্তোলন, স্লুইচ গেটের মুখ খোলা, পানি নিষ্কাশনের পথ না থাকা এবং খাল ও নদী ঠিকমত খনন না হওয়ায় জেলায় প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে এভাবে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ছে।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি বিভিন্ন বিলে লোনা পানি তোলার পরে অতি বর্ষণে বিলের পানি নিষ্কাশিত না হওয়ায় জেলার সবগুলো উপজেলায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। জলাবদ্ধতায় জেলায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তালা ও কলারোয়া উপজেলা। তালা উপজেলা সদর, জালালপুর, ইসলামকাটি, তেতুঁলিয়া, মাগুরা, খেশরা, সরুলিয়া, ধানদিয়া, খলিলনগর ইউনিয়নের ৩০ থেকে ৪০ টি গ্রামে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। কলারোয়া উপজেলার দেয়াড়া ও জয়নগর ইউনিয়নের বেশকিছু পরিবার পার্শবর্তী একটি মাদ্রাসায় আশ্রয় নিয়েছে। কপোতক্ষ নদ ভরাট হওয়ার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কপোতাক্ষ নদ খননের জন্য শেখ হাসিনা সরকার ২৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। খননের নামে চলছে মহা লুটপাট। যেন দেখার কেউ নেই। সরকারদলীয় অধিকাংশ নেতা-কর্মী এ ব্যাপারে চুপ। এসব নেতারা খনন প্রকল্পের টাকা লুটপাটের সাথে সরাসরি জড়ীত বলে অভিযোগ রয়েছে। যে দুই একজন জনপ্রতিনিধি এনিয়ে কথা বলছে বা আন্দোলন করছে তারা অনেক খানি লোক দেখানো আন্দোলনে নেমেছে। এ মন্তব্য স্থানীয় সাধারণ মানুষের।
সূত্র জানায়, জেলার সবচেয়ে বেশি জলাবদ্ধতার শিকার সাতক্ষীরা সদর উপজেলা। উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের প্রত্যেকটিতে বিলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। জলাবদ্ধতার কারণে অন্তত ৪৫ হাজার বিঘা জমির ফসল চাষের আওতায় আনা যাচ্ছে না। এই উপজেলার বল্লী, ঝাউডাঙ্গা, লাবসা, ফিংড়িতে বেশি জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। বেতনা নদী দিয়ে পানি নিস্কাশন না হওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বেতনা নদী খননের জন্যও শেখ হাসিনা (জলবায়ু ট্রাষ্টের ফান্ড) সরকার প্রায় ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু সেখানেও লুটপাটের কাহিনী কপোতাক্ষের মতই। নাম মাত্র কাজ করে জেলার কয়েকজন চিহ্নিত ও বিতর্কীত প্রভাবশালী ঠিকাদার পাউবোর সাথে মিলেমিশে লুটপাট করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সরেজমিন তথ্য অনুসন্ধানে জানাগেছে, কলারোয়া উপজেলায় জয়নগর, দেয়াড়াসহ কয়েকটি ইউনিয়নের অন্তত ১০টি বিলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
তালা উপজেলার পাটকেলঘাটা, সরুলিয়া, ইসলামকাটিসহ কয়েকটি ইউনিয়নে ২৬ হাজার বিঘা জমিতে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। দেবহাটা উপজেলায় ৫ হাজার বিঘা, কালিগঞ্জ উপজেলার সাড়ে ৪ হাজার, আশাশুনি উপজেলার ৩ হাজার বিঘা এবং শ্যামনগর উপজেলার দেড় হাজার বিঘা জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।
সূত্র জানায়, চলতি মাসের শুরুতে সদর উপজেলার লাবসা ইউনিয়নের খেজুরডাঙ্গা, কুন্দুরানীসহ কয়েকটি স্লুইচ গেট দিয়ে মৎস্য ঘেরে লোনা পানি উঠানো হয়। এই পানি বল্লী ও ঝাউডাঙ্গা ইউনিয়নের বিভিন্ন বিলে প্রবেশ করে। সম্প্রতি বৃষ্টির পানি এ পানির সাথে যোগ হওয়ায় ওই তিন ইউনিয়নের প্রত্যেটি বিলে কানায় কানায় ভরে গেছে পানি।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার দেবনগর গ্রামের সোহরাব হোসেন জানান, গত দুই দিনের বৃষ্টির বিলে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিল কানায় কানায় পানিতে ভরে গেছে। দুই দিন আগে মাত্র ২/৩ ইঞ্চি পানি কমলেও শুক্রবার আরো পানি বেড়েছে। তিনি জানান, এভাবে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে এলাকার বাড়ি ঘরে প্রবেশ করবে।
অন্যদিকে, জলাবদ্ধতা নিরসনে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে অবৈধ নেট-পাটা অপসারণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও দৃশ্যমান কোন কাজে আসছে না বলে জানান অনেকে। তারা দ্রুত জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করে বলেন, দ্রুত জলাবদ্ধতা নিরসন না হলে জেলা কৃষির উপর নির্ভর মানুষ দারুন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। খাদ্য ঘাটতির মধ্যে পড়বে কৃষকরা।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুল মালেক ভয়েস অব সাতক্ষীরা ডটকমকে জানান, বর্ষায় বিলে পানি বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। কাজ করা হচ্ছে। পানি নিস্কাশনের জন্য ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ভয়াবহ এই পরিস্থিতি কি ভাবে বা কোন কৌশলে নিরসনের পদক্ষেপ নিয়েছেন জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা তার কোন সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।