
মো. আসাদুজ্জামান :
গরিবের ভরসা সেই ‘১০ টাকার ডাক্তার’ এবাদুল্লাহ এবার সাড়া পেলেন বিদেশী বন্ধুদের। সম্প্রতি ভয়েস অব সাতক্ষীরা ডটকমসহ বিভিন্ন গনমাধ্যমে সাতক্ষীরার সাবেক সিভিল সার্জন ডা: এবাদুল্লাহকে নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তার সাথে কাজ করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছেন প্রবাসী বন্ধুরা। প্রবাসী একাধিক বন্ধু গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ পড়ে মুগ্ধ হয়ে ডা: মো: এবাদুল্লাহ্ সাথে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
এতে করে গরিবের ভরসা ডা: এবাদুল্লাহ নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়েছেন। মানব সেবায় চির উদ্দিপ্ত ডা: এবাদুল্লাহ বিদেশী বন্ধুদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে অন্তরের অন্ত:স্থল থেকে সাংবাদিকদেরকে জানিয়েছেন কৃতজ্ঞতা।
ডা: মো: এবাদুল্লাহ’র অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, যৌবনের উদ্দিপনাকে উপেক্ষা করে গরীব, দুখি, অসহায় মানুষের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছি। টাকার পিছনে ছুটিনি, ছুটেছি আর্তপীড়িত মানুষের পিছনে। তারপরও অনেকে ৫ টাকার ডাক্তার বলে বিদরূপ মন্তব্য করে। তার পরও আমি থেমে থাকিনি। শুধুমাত্র গরীব মানুষের কথা ভেবে আমি আমার ফি বাড়াইনি। আমাকে নিয়ে কখনও কেউ সেইভাবে কাজও করিনি। কিন্তু সাংবাদিকরা আমার পাশে দাড়িয়ে এজন্য কী বলে ধন্যবাদ দেব।
তিনি আরো বলেন, যেদেশের মানুষ দু’বেলা দু মুঠো অন্ন জোগাড় করতে পারতো না, বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে নিভে যেত যাদের জীবন প্রদিপ। আমি তাদের চিকিৎসার কথা ভেবেছি। কিন্তু সরকারি বা বে-সরকারিভাবে স্বীকৃতি পাইনি। আজ গর্বে আমার বুক ভরে গেছে। চাকরি জীবন শেষে আজ আমার স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। বিশ্ববাসীর কাছে সাংবাদিকরা আমাকে যেভাবে তুলে ধরেছে তাতে আমার জীবন ধন্য। আমার স্বপ্ন গরীব দুখি মানুষের মাঝে বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করা। পরীক্ষা-নিরিক্ষার অভাবে যে সব অসহায় মানুষ সঠিকভাবে চিকিৎসা সেবা পান না তাদের জন্য আমি স্বপ্ল খরচে পরীক্ষা-নিরিক্ষার ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু সেটি বিশ্বমানের নয়।
এব্যাপারে সহযোগীতা পেলে কৃষক, শ্রমিক, রিক্সা চালক, ভ্যান চালক, খেটে খাওযা দিনমজুরা স্বপ্ল খরচে রোগ নির্ণয়ের সুযোগ পাবে। একই সাথে এসব ছিন্নমূল মানুষের বেচে থাকার আকাঙ্খা বেড়ে যাবে।
এদিকে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ নিমাই চন্দ মন্ডল বলেন, আমি একদিন তার চিকিৎসা সেবা নিয়ে ধন্য হয়েছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন সাতক্ষীরা শহরে তখন ভালো ডাক্তার ছিল না কিন্তু আমার সমস্যাটা ছিল প্রকট। ডা: এবাদুল্লাহ তখন ফি নিতেন পাঁচ টাকা। বিশ্বাসই করতে পারিনি। তারপর ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে সেবা নেওয়ার পর আমার বিশ্বাস আরো দৃড় হয়।
শুধু প্রবীন এই শিক্ষাবীদ নয়, হাজারো শিক্ষক, কৃষক, রিক্্রাচালক, দিনমজুর, সাংবাদিক, সরকারি বা বেসকারি চাকরীজীবীসহ এমন কোন পেশার মানুষ নেই যিনি সেই আমলের পাঁচ টাকার ডাক্তার এবাদুল্লাহ’র চিকিৎসা সেবা পেয়ে আরোগ্য লাভ করেনি। তিনি বলেন এটি আল্লাহ্ রহমত আর আমার চেষ্টা।
—————————————————-
গরিবের ভরসা ‘১০ টাকার ডাক্তার’ এবাদুল্লাহ
—————————————————-
‘আমার পক্ষে ৪০০-৫০০ টাকা ফি দিয়ে ডাক্তার দেখানো সম্ভব নয়। সদর হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে হলে অনেক সময় লাইন দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এতে করে একটি দিন নষ্ট হয়। আয় করতে পারি না। একদিন আয় না করলে পেট চলে না।’ পেশায় রিকশাচালক ৫০ ঊর্ধ্বো শিবপদ দাস এভাবেই নিজের অবস্থানের কথা জানান দিলেন।
তিনি আরও বলেন, সাতক্ষীরাসহ আশেপাশের শহরে প্রাইভেটভাবে যেসব এমবিবিএস ডাক্তাররা রোগী দেখেন তারা ৫০০-৬০০ টাকা ফি নেন। তাই তার মতো অনেকেরই ভরসা ‘১০ টাকার ডাক্তার’ এবাদুল্লাহ। ডা. মো. এবাদুল্লাহ প্রায় বিনামূল্যে ৪০ বছর ধরে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
শিবপদ বলেন, ‘আমি এবং আমার পরিবার প্রায় ৩০ বছর ধরে তার কাছে চিকিৎসা নিচ্ছি। তিনি সব রোগীর ভালোভাবে চিকিৎসা করেন।’
এ নিয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় সাবেক সিভিল সার্জন ডা. এবাদুল্লাহ’র সঙ্গে। তিনি বলেন, মধ্যবিত্ত পরিবারে তার জন্ম। ১১ ভাই-বোনের তিনি ছিলেন সবার বড়। পড়ালেখায় ভালো হওয়ার তার দায়িত্ব নিয়েছিলেন তার দাদা নওয়াব আলী। দাদা বলেছিলেন, ‘মানুষের জন্য ডাক্তার হও। ডাক্তার হয়ে ব্যবসা না করতে।’
দাদার সেই কথাকে মনে রেখে মাত্র ৫ টাকা ফি নিয়ে প্রায় ৪০ বছর ধরে সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন তিনি। তার ক্লিনিকের নামও দিয়েছেন দাদার নামে। ‘নওয়াব ক্লিনিক’।
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার হামিদ আলী হাইস্কুল থেকে ১৯৬৮ সালে প্রথম শ্রেণিতে এসএসসি পাশ করেন। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ১৯৭০ সালে খুলনার বিএল কলেজ থেকে এইচএসসি পরীরক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পড়ালেখা বাদ দিয়ে ফিরে আসেন নিজের এলাকায়। যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতেন এবং তাদের সঙ্গে ঘুরেছেন বিভিন্ন জায়গায়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ফিরে যান রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে। ১৯৭৭ সালে এমবিবিএস পাশ করেন। ইন্টার্নি শেষে সহকারী সার্জন হিসেবে রাজশাহী মেডিক্যালেই যোগ দেন। পরে ১৯৮০ সালে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ স্বাস্থ্য কম্পপ্লেক্সে পল্লী চিকিৎকদের ট্রেনার হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ২০১০ সালে তিনি অবসরে যান।
গরীব মানুষের কাছে টাকা নিতে তার বিবেকে বাধে। তার কাছে সেবাই পরম ধর্ম। সমাজের সব শ্রেণির মানুষই যেন তার কাছ থেকে সেবা নিতে পারে সে ব্রত নিয়েই কাজ করছেন।
সব কিছুর দাম বাড়লেও ফি বাড়েনি সাবেক এই সিভিল সার্জনের চিকিৎসা সেবার। ৪০ বছর আগে রোগী প্রতি যে ফি নির্ধারণ করেছেন তিনি এখনও রোগী প্রতি সেই ফি নেন। অন্য চিকিৎসকদের মতো নেই লোভ-লালসা।
তিনি জানান, সরকারি দায়িত্ব পালনের সময় তিনি অফিস শেষে দিনের বাকি সময়টা নিজস্ব চেম্বারে ৫ টাকা ফি নিয়ে বিভিন্ন স্তরের মানুষের সেবা দিয়েছেন। যা আজো অব্যাহত রেখেছেন।
সম্প্রতি সেই ফি ৫ টাকার পরিবর্তে ১০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অনেক নার্স স্টাফ কাজ করে তাদের বেতন দিতে হয়। সেসব বিষয় ভেবে ৫ টাকার পরিবর্তে ১০ টাকা ফি করা হয়েছে। এখনও অনেকে ৫ টাকা ফি দিয়ে থাকেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি মানুষের কাছে টাকা নয়, দোয়া চাই। রাস্তায় দেখা হলে আমাকে সালাম দেয় সম্মান করে এটাই আমার বড় পাওয়া। আমার কাছে চিকিৎসা নিতে আসে ভ্যান চালক, রিকশাচালক, খেটে খাওয়া মানুষ। এদের কাছে টাকা চাইতে খারাপ লাগে, যে যার খুশি মত দেয়।’
ডা. এবাদুল্লাহর কাছে চিকিৎসা নিতে আসা রিজিয়া খাতুন বলেন, ‘বেশি টাকা দিয়ে ডাক্তার দেখানোর ক্ষমতা নেই আমার। এজন্যই এখানে এসেছি। ৫ টাকা দিলেও ডাক্তার সাবেক কিছু বলেন না। অনেক সময় ওষুধ তিনি ফ্রি দেন। এক কথায় তার কাছে আমাদের সমস্যা মেটে। সত্যিই তিনি গরিবের বন্ধু।’
সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন ডা. উৎপল কুমার দেবনাথ বলেন, বর্তমান সময়ে ৫-১০ টাকা কিছু না। এটিকে বলা যায় এক প্রকার বিনা পয়সায় চিকিৎসা। তিনি চিকিৎসা সেবাতে যে অবদান রাখছেন তা উজ্জল দৃষ্টান্ত।