‘১৪ আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার শেষ দেখা’


630 বার দেখা হয়েছে
Print Friendly, PDF & Email
‘১৪ আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার শেষ দেখা’
আগস্ট ২৬, ২০২০ ফটো গ্যালারি সাতক্ষীরা সদর
Print Friendly, PDF & Email

(সাক্ষাৎকার ভিত্তিক রিপোর্টটি লিখেছেন যুগান্তরের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি সুভাষ চৌধুরী)

সাক্ষাৎকারে সাতক্ষীরার সাবেক সাংসদ এ কে ফজলুল হক

‘আজিজ তোর কি বিশ^াস হয় বাংলার মানুষ আমাকে মারতে পারে’ বঙ্গবন্ধুর মুখে এ কথা নিজ কানে শুনে আমি ও আমরা হতবাক। চুপচাপ বসে থাকলাম। পরপরই তিনি বললেন ‘আমার কাছে রিপোর্ট আছে ,কিন্তু আমি তা বিশ^াস করতে পারিনা’। আমরা বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা শেষ করে দরজা খুলতেই দেখি বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও সাতক্ষীরার শ্যামনগরের সংসদ সদস্য মো. মহসীন। বাসায় ফিরে বারবার বঙ্গবন্ধুর কথাটি মনে পড়তে লাগলো। পরদিন সকালে হোটেলে বসে রেডিওতে শুনলাম বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৭৫ এর ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সাথে শেষ সাক্ষাতের এই বিবরন দিয়ে সাতক্ষীরার সাবেক সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা একে ফজলুল হক বলেন আগস্ট বিশেষ করে ১৪-১৫ আগস্ট এলেই আমার মনে ভেসে ওঠে সেদিনের কথা। সেদিনের ছবি।
আজ বুধবার যুগান্তরের সাথে এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের সাবেক সাংসদ একে ফজলুল হক বলেন ‘আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম বঙ্গবন্ধু ১৫ আগস্ট জেলা গবর্ণরদের নাম ঘোষনা করবেন। আর এজন্য সারা দেশের সংসদ সদস্য, সাবেক সংসদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগ নেতারা তখন ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। গবর্নর ঘোষনার পর তিনি থানা অ্যাডমিনিস্ট্রেটরদের নাম ঘোষনা করবেন বলেও শুনতে পারছিলাম’।
সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে আমার অনুরোধ মোতাবেক পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ী খুলনা জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মন্ত্রী শেখ আবদুল আজিজ, সাতক্ষীরার সংসদ সদস্য সৈয়দ কামাল বখত সাকি ও আমি বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাত করতে যাই ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায়। গণভবনে আমরা পৌছে নেতার কক্ষে ঢুকেই দেখি তিনি সাদা লুঙ্গি ও হাতাওয়ালা গেঞ্জি পরে পাইপ হাতে পায়চারি করছেন। তাকে এ সময় খুবই উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছিল। আমাদের বসতে বলে তিনি বাথরুমে যান। ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু বলেন ‘আজিজ তোমাদের কথা তাড়াতাড়ি বলে ফেলো। আমি খুব ব্যস্ত আছি’। আজিজ ভাই বললেন ‘নেতা তুমি আজ পর্যন্ত আমার কোনো কথা ফেলোনি। আগামিকাল ঢাকা ইউনিভর্সিটিতে তোমার অনুষ্ঠান আছে। শুনেছি সেখানে তুমি নতুন গবর্ণরদের নাম ঘোষনা করবে। এর পরবর্তী পদক্ষেপ কী তাই জানতে এলাম’। আমাকে দেখিয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন ‘বুঝতে পেরেছি তোমরা কেনো এসেছো । আমি ধাপে ধাপে দেশকে শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ করতে যা যা করা দরকার তাই করবো। তোমরা জানতে এসেছো পরবর্তীকালীন পদক্ষেপ কি হবে। এরপর আমি প্রত্যেক থানায় থানা অ্যাডমিনিস্ট্রেটর তৈরি করবো। তুমি এবং সাকি এসেছো শ্যামনগরের জন্য। তোমার এই ছেলেটার কথা আমার মনে আছে’।
বঙ্গবন্ধু তার কথা শেষ করেই বলে ফেললেন ‘আজিজ তোর কি বিশ^াস হয় বাংলার মানুষ আমাকে মারতে পারে? ’। আমরা নীরবে স্তব্ধ হয়ে কিছু সময় চুপ করে বসে থাকলাম। আবার বঙ্গবন্ধু কথা শুরু করে বললেন ‘আমার কাছে রিপোর্ট আছে, কিন্তু আমি তা বিশ^াস করতে পারি না। সেজন্য আমি সবসময় আল্লাহর ওপর ভরসা করে চলেছি, যা কিছু করছি এই বাঙালির জন্য, এই দেশের জন্য’। এরপর আমরা আর কোন কথা না বাড়িয়ে ওঠার সময় বললাম ‘আপনি খুবই ব্যস্ত আছেন। আগামীকাল আপনার অনুষ্ঠান। অনেক লোক দেখা করার জন্য আসছেন। বাইরে অপেক্ষা করছেন। আল্লাহর ইচ্ছায় পরে দেখা হবে’ বলেই আমরা বেরিয়ে এলাম। দরজা খুলতেই দেখি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও সাতক্ষীরার সংসদ সদস্য মোঃ মহসীনসহ অনেকে দাঁড়িয়ে আছেন’। এসময় মোশতাক আহমেদ বললেন, ‘আজিজ ভাই, এত সময় নিলেন? ’ একথা শুনে আমরা চলে আসলাম। আর মোশতাক আহমেদসহ অন্যরা ভেতরে গেলেন। ১৪ই আগস্ট রাতে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে এটাই ছিল আমাদের শেষ সাক্ষাত।
সাবেক সাংসদ একে ফজলুল হক তার সাক্ষাতকারে আরও বলেন, আমি থাকতাম ঢাকার টিএন্ডটি কলোনীর সামনে নূরানী হোটেলের দ্বিতীয় তলায়। হোটেলে এসেও বারবার বঙ্গবন্ধুর সেই আশঙ্কার কথাটি মনে আসতে থাকলো। এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। পরদিন ১৫ই আগস্ট। ভোরেই হোটেলের বয় এসে দরজায় ধাক্কা দিলো এবং বললো ‘স্যার উঠুন এক্ষুনি দরজা খোলেন’। আমি দরজা খুললাম। হোটেল বয়টির হাতে তখন একটি রেডিও। মেজর ডালিমের ভাষায় ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে’। বারবার এই কথাটি রেডিওতে উচ্চারিত হতে থাকলো। হোটেলের বয়টি কান্নায় ভেঙে পড়লো। সে আর বেশিক্ষন দাঁড়াতে পারলো না। আমিও হতভম্ব হয়ে গেলাম। আল্লাহর কাছে বললাম, আল্লাহ তুমি এ কোন কঠিন সমস্যায় ফেললে। এভাবেই আমার চোখ দিয়ে শুধুই পানি ঝরতে থাকলো। হোটেলের বারান্দায় বসে দেখলাম শুধু আর্মির গাড়ি রাস্তায় চলাফেরা করছে এবং মাইকে বঙ্গবন্ধু হত্যার কথা বারবার প্রচার দিচ্ছে। এ কোন দেশ আমাদের, এ কোন বাঙ্গালি । যে দেশের শ্রেষ্ঠ নেতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি শেখ মুজিবকে কাপুরুষের মতো রাতে আঁধারে সপরিবারে হত্যা করে রাস্তায় প্রকাশ্যে ঘোষনা দেয়। এ দৃশ্য আমি স্বচক্ষে দেখেছি। তাদের মাইক প্রচার স্বকানে শুনেছি। আজ অবধি সেকথা আমি ভুলতে পারিনি, গভীর দাগ কেটে আছে আমার মানসপটে।
সাবেক সাংসদ একে ফজলুল হক আরও বলেন, জানি না খুনী মোশতাক সেদিন বঙ্গবন্ধুর কক্ষে ঢুকে কি কথা বলেছিলেন। এখন বড়ই আফসোস হয় সেকথা যদি জানতে পারতাম তাহলে আগেভাগে সবার কাছে তুলে ধরতে পারতাম। আগস্ট এলেই এসব কথা আমার মনে পড়ে। কতিপয় বিপথগামী সেনা সদস্যের ঘৃণ্য উদ্দেশ্যে ও তাদের অপঘাতে প্রিয় নেতার প্রাণনাশের মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে আমাদের এই সাক্ষাত চিরদিন বুকে বিঁধে থাকবে। নেতার জন্য দোয়া করি, তার আদর্শ ধারন করে যেন চলতে পারি এটাই আল্লাহর কাছে আমার প্রার্থনা।

#