
॥ উমর ফারুক ॥
ইলেক্ট্রা আমার প্রিয়তমার ছদ্মনাম। ওর আসল নাম সরকার জানে। ইলেক্ট্রা নীল শাড়ি পরে। নীল শাড়ি, লাল পাড়। সবুজ ঘাসে পা রাখে। রিক্সা, মেঠোপথ আর রেললাইন ওর পছন্দ। খোলাআকাশ, বৃষ্টি ওর পছন্দ। ইলেক্ট্রা স্বপ্ন দেখে। দেখায়ও। কাঁদায়, আবার হাসায়ও। লেখে, আবার লেখায়ও। আর এ সবই রাষ্ট্র জানে। রাষ্ট্রকে সব খবরই রাখতে হয়। রাষ্ট্র বলে কথা! দায়িত্বশীল রাষ্ট্রতো খবর রাখবেই! মেয়েটার প্রেমে ব্যর্থ হয়ে, একবার আমি আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলাম। শেষমেষ আর হয়ে ওঠে নি। রাষ্ট্রের চিন্তা করেই আর হয়ে ওঠে নি। পাছে সবাই নির্দোষ রাষ্ট্রকেই দায়ি করে! বলে, রাষ্ট্র আমাকে গুম করেছে। বর্তমান সময়টা বড় উদ্ভট! অবাক করা সময়। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে মানুষ ঘর ছাড়ছে। আর ফিরছে না। ব্যবসায়ে ব্যর্থ হয়ে মানুষ ঘর ছাড়ছে। আর ফিরছে না। অথচ মানুষ দুষছে সরকারকে। বলছে ওরা নাকি গুম হয়েছে। আসলে গুম-টুম কিছু নয়, সবই নিরুদ্দেশ। স্বেচ্ছায় নিরুদ্দেশ। সেদিন পত্রিকার পাতায় একজন মন্ত্রীর ‘মিট দ্যা প্রেস’ বক্তৃতা পড়ছিলাম। তিনি বলছিলেন, দেশে কোনো গুম হচ্ছে না। যেগুলোকে আমরা গুম বলছি, সেগুলো আসলে গুম নয়। কেউ প্রেমে ব্যর্থ হয়ে গুম হয়ে যান, কেউ ব্যবসায়ে ব্যর্থ হয়ে গুম হয়ে যান। প্রকৃত ঘটনা যাই হোক, বিষয়টা কিন্তু মজার। রাষ্ট্র বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার খবর না রাখলেও মানুষের প্রেমে ব্যর্থতার খবর ঠিকই রাখছে! এজন্য অন্তত রাষ্ট্র ধন্যবাদ পেতেইে পারে।
গণমাধ্যম বলছে, বর্তমানে সারাদেশে একটি ছাত্রসংগঠন ত্রাস সৃষ্টি করছে। সাংগঠনিকভাবে অথবা বিচ্ছিন্নভাবে, যেভাবেই হোক, শান্তির নামে তারা অশান্তি সৃষ্টি করছে। অথচ সেই দলের সাধারণ সম্পাদক বলছেন, ‘কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল শিক্ষকদের ওপর হামলার ঘটনা তাদের ছাত্রসংগঠনের নাম ভাঙ্গিয়ে অন্যকেউ করতে পারে।’ তিনি এও দাবি করেছেন, তাদের ছাত্রসংগঠনের এখন কোনো কমিটি নেই। সম্মেলেনের পর এখনো নতুন কমিটি ঘোষিত হয়নি। তিনি বলেছেন, তাদের ছাত্রসংগঠনের নামে কেউ কিছু করেছে কিনা জেনে বলতে হবে। আই অ্যাম নট শিওর। আমরা যতোটুকু জানি ছাত্রসংগঠনটির কেন্দ্রিয় কমিটির সম্মেলন হয়েছে। এর ফলে সারাদেশে সংগঠনটির সব কমিটি স্থগিত/বাতিল হয়ে যায় কিনা আমরা তা জানি। উই আর নট শিওর। আমরা শুধু এটুকু নিশ্চিত করে বলতে পারি, দেশাত্ববোধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ-লালিত কোনো ছাত্রসংগঠনের দিকে কেউ আঙ্গুল তুললে আমরা অত্যন্ত কষ্ট পাই। আবার তারা অন্যকাউকে আঘাত করলে, কিংবা অন্যকারো দিকে হুমকির আঙ্গুল তুলতেও আমরা কষ্ট পাই।
১৭ ফেব্র“য়ারি ২০১৮, থেকে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে শিক্ষার্থীরা। একসময় সারাদেশের প্রায় সব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান উত্তাল হয়ে ওঠে। তখন সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী কোটা বাতিল করার ঘোষণা দেন। যদিও আন্দোলনকারীরা কখনোই কোটা বাতিলের দাবি তোলে নি। তবুও প্রধানমন্ত্রীর বাড়তি আশ্বাসে তারা ঘরে ফেরে। শ্রেণিকক্ষে ফেরে। সেদিন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল একজন মায়ের মতো। একজন সর্বজনীন অভিভাবকের মতো। আমরা যতোটুকু জানি, প্রধানমন্ত্রীর আইনগত মৌখিক ঘোষণা কেবল লিখিত আদেশের অপেক্ষামাত্র। অথচ তাঁর ঘোষণার দীর্ঘদিন পর কেবল একটি পর্যালোচনা কমিটি হয়। বর্তমানে সে কমিটির মেয়াদ আরও ৯০দিন বৃদ্ধি করা হয়েছে। যা কারো কারো কাছে রহস্যময় বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রী অন্যায় দাবির কাছে মাথানত করেন না। অতএব, তার দাবি মেনে নেয়াই প্রমাণ করেছিল কোটা আন্দোলনের দাবি ছিল যৌক্তিক। অতএব সে দাবি দ্রুততম সময়ে মেনে নেয়াটা ছিল আরও বেশি যৌক্তিক। কিন্তু অতিসম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বুঝতে পারছি না কোটাপদ্ধতির বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক আন্দোলনের পেছনে কী যুক্তি কাজ করছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আন্দোলনের অরাজক পরিস্থিতি দেখে আমি বলেছিলাম, ঠিক আছে কোটা থাকবে না।’ শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে এক মহাসংকটে পথ দেখিয়েছিলেন। নিজের বাবা, পরিবার তথা সবকিছু হারিয়ে দেশের মানুষের মাঝে তিনি স্বজনকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। সেই প্রচেষ্টায় তিনি সফলও হয়েছেন। তিনি বাংলাদেশকে পৌঁছে দিয়েছেন এক অনন্য উচ্চতায়। সারাবিশ্বে বাংলাদেশ আজ একটি অনুকরণীয় নাম। প্রচণ্ড অন্ধকারে বাংলাদেশ আজও তাঁর দৃষ্টিতেই পথ চলে। আন্দোলন, সংগ্রাম তাঁর নির্দেশনায় সঠিক পথ খুঁজে পায়। তাঁর হাত ধরেই এদেশের মানুষ ভাতের অধিকার পেয়েছে। ফলে, যৌক্তিক দাবি পূরণের জন্য জনগণ এখনও তাঁর মুখেই চেয়ে থাকে। তার ডাকে রাজপথে নামে। তাঁর আশ্বাসেই রাজপথ ছেড়ে যায়। কারণ শেখ হাসিনা এদেশের কোটি মানুষের সাথে কখনো প্রতারণা করেন না। মিথ্যে আশ্বাস দেন না। অসত্য বলেন না। বরং যা বিশ্বাস করেন কেবল তাই বলেন। অবিবেচনাপ্রসূত কোনো মন্তব্য তিনি করেন না। এটাই গণমানুষের বিশ্বাস। গণমানুষ বিশ্বাস করে, তিনি যেমন চাপের কাছে নতিস্বীকার করেন না, যেমন অন্যায় দাবির কাছে মাথানত করেন না, তেমনি কারো যৌক্তিক দাবি পূরণে পিছুও হটেন না। যার প্রমাণ তারা দেখেছিলাম যুদ্ধাপরাধীর বিচারের সময়। তাইতো কোটা আন্দোলন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস এদেশের সহস্র মানুষকে যেমন নিশ্চিন্ত করেছিল। তেমনি বর্তমানে উদ্বিগ্নও করে তুলেছে। চিন্তিত করে তুলেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, শেখ হাসিনাকে এদেশের সহস্র মানুষ আপা বলে ডাকে। তারা মনে করে, শেখ হাসিনা তাদের শেষ আশ্রয়স্থল।
২০০১ সালে আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। তখন সারাদেশে ত্রাসের রাজত্ব চলতো। তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও ত্রাসের রাজত্ব চলতো। তবে তখন আমরা ৩৮টাকায় খাবার পেতাম না। পেতাম ১৮ টাকায়। দুপুর ও রাত। তখন এটা নিয়ে কোনো খোটা শুনি নি। কিন্তু মন্ত্রীদের কণ্ঠে শুনতাম, ‘আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে।’ স্বাভাবিক মৃত্যু তখন খানিকটা অপ্রত্যাশিত ছিল। তখন প্রতিবাদীদের ডানা কেটে দেয়া হতো। তখন সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অসুস্থ করে তুলেছিল। স্বাধীন মত ও পথচলার সুযোগ ছিল না। তখন দেশে ভোট ও ভাতের অধিকার ছিল না। ঠিক তখনই, তরুণ-প্রজন্ম পরিতর্বনের আশায় আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় আনে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আজও আমাদের শুনতে হয়, প্রেমে ও ব্যবসায়ে ব্যর্থ হয়ে নাকি হারিয়ে যাচ্ছে মানুষ। শুনতে হচ্ছে, দেশে গুম বলে কিছু নেই। সবই নিরুদ্দেশ।
জিনাত শারমিন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিকের শিক্ষক। চিন্তায় তিনি একজন গতিশীল মানুষ। ভেতরে-ভেতরে ও ভেতরে-বাহিওে প্রচণ্ড প্রতিবাদী ও প্রগতিশীল মানুষ তিনি। তার ভাবনায় দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তা খেলা করে। সেদিন যখন শিক্ষার্থীদের থাকা-খাওয়ার খোটা এলো সেদিন তাকে খুব বিচলিত দেখা গেল। যেদিন ওরা তানজীম উদ্দিন খান স্যারের দিকে আঙ্গুল তুললো সেদিও তাকে খুব চিন্তিত দেখালো। ওইদিন বিকেলে তিনি ফেসবুকে লিখলেন, ‘একটি আঙুল হাতে রূপান্তরিত হতে কয়দিন লাগে? সেই হাতের চাপে গলা থেকে শেষ শ্বাসটুকু বের হতে কয় মিনিট? জীবনে প্রথমবারের মতো দেশত্যাগ নিয়ে ভাবছি, সিরিয়াসলি ভাবছি। নিজের গলা বাঁচাতে না, ছেলের মাথা আর পা বাঁচাতে।’ হয়তো জিনাত শারমিন আপার মতো সহস্র মানুষ আজ চিন্তিত। নীরবে চিন্তিত। বর্তমান সময়কে অধিকাংশ মানুষই মেনে নিচ্ছে না, মনেও নিচ্ছে না। শুধু নীরবে কষ্ট পাচ্ছে। এদেশ, সমাজ আজ আমাদের জন্য নিরাপদ নয়। আমাদের সন্তানের জন্য, আগামির বাংলাদেশ জন্য পুরোপুরি বাসযোগ্য নয়, এমনটাই ভাবছে সবাই।
আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রতিবাদী মানেই প্রতিক্রিয়াশীল নয়। ভিন্নমত মানেই বিএনপি-জামাত নয়। আন্দোলন মানেই প্রতিক্রিয়াশীলদের নয়। ক্রিয়াশীলদেরও হতে পারে। দেশ ও দলের প্রকৃত বন্ধু তো তারা যারা সুবিধাবদী নয়। বরং তারা যারা বিভ্রান্ত সময়ে সঠিকপথ দেখাতে রাজপথে থাকে। যদি কোটা আন্দোলনকরীদের কেউ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটুক্তি করে থাকে, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অপমানিত করে থাকে, শেখ হাসিনাকে অপমানিত করে থাকে, উপাচার্যের বাড়ি পুড়িয়ে থাকে তবে তা জঘন্য অপরাধ। আমরা ঘৃনা জানাই সেই কর্মকাণ্ডের। তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। কিন্তু আইন নিজ হাতে তুলে নেয়া প্রত্যাশিত নয়। পুরো আন্দোলনকে ভিন্নব্যাখ্যা দেয়া অশোভন। আমরা চাই দেশটা ভালো থাকুক। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র আগামী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ বাসভূমি হয়ে উঠুক। একথা সত্য দেশে এগিয়ে যাচ্ছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই অগ্রগতি আমাদের প্রত্যাশাকে কতোটুকুইবা মেটাতে পেরেছে সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। জিনাত শারমিন আপাদের যেনো দেশ ছেড়ে তাদের অতৃপ্ত-ভালোবাসার মূল্য দিতে না হয়। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, এ দেশে কোনো সন্ত্রাসীর নয়। বিশ্বাস করতে চাই, এ দেশে কোনো গুম হয় না। নিরুদ্দেশও নয়। আমরা স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চাই। আমরা নিরাপদ রাষ্ট্র চাই। আমরা নিরাপদ বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনা চাই। আমরা চাই সব অভিমানী প্রেমিকরা ফিরে আসুক। শান্তিময় ও ভালোবাসাময় হয়ে উঠুক বাংলাদেশ।
লেখক : উমর ফারুক
শিক্ষক
অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস্ বিভাগ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
ই-মেইল: faruque1712@gmail.com