ডেস্ক রিপোর্ট ::
আবহমান বাংলার রূপবৈচিত্র দেখতে যেয়ে কালজয়ী সৃষ্টি ‘পদ্মানদীর মাঝি’র অগত্য মিল ‘খোলপেটুয়া নদী ও কপোতাক্ষ নদ’ প্রেমের একখানি উপন্যাস আবিষ্কার করার মতন ঘটনা বলা যেতে পারে।বৃহত্তর খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়ন থেকে শ্যামনগর উপজেলার গন্তব্য নওয়াঁবেকী বাজারের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা ইঞ্জিনচালিত নৌকা ট্রলারের ভ্রমন এক অসাধারণ কাব্যিক ও প্রেমের উপন্যাস সৃষ্টি করার মুহূর্ত।
সূর্যোদয়ের সাথে সাথে কর্মব্যস্ত মানুষের চাঞ্চল্য ও কর্মব্যস্ততা অনুপ্রাণিত করে কর্মঠ হতে।প্রাতঃকালে কর্মব্যস্ত মানুষজন ছুটে চলে।
সাঁঝসকালে নৌকায় ভ্রমণ অসাধারণ এক অনুভূতির সৃষ্টি মাত্র।জেলেদের নৌকাযোগে মাছ ধরা, পাখপাখালি কিচিরমিচির ডাক ডাকে, তীব্র জোয়ার ভাটার তালে নৌকাগুলো ছুটে চলে,নদীর ছোটবড় মাছগুলো সাঁতারাতে থাকে, নদীর কিনারায় মা-বোনদের নেটজাল টানার দৃশ্য, সূর্যোদয়ের নয়নাভিরাম দৃশ্য, নদীর তীরবর্তী সুন্দরবন ভিত্তিক ক্ষুদ্র বনায়ন কর্মসূচি, বেড়িবাঁধ সুরক্ষা মেগা প্রকল্পের কাজ দৃশ্যমান, ওয়াপদা রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলা কর্মব্যস্ত মানুষজন, নদীর তীরে বাড়িঘর ইত্যাদি চিত্রগুলো সত্যিই অসাধারণ। কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী ছাড়াও উত্তর বেদকাশী দীঘির পাড়, কাছারীবাড়ি, কাঠকাটা, সদর কয়রা, বড় বাড়ি, মহারাজপুর, বাগালী, বাঁশখালি, মহেশ্বরীপুর, তেতুলবাড়িয়ারচর, হড্ডা, বানেখালী, শ্যামখালী, কুমখালীসহ প্রত্যন্ত কয়রা অঞ্চল ঘুরেফিরে একই ফ্রেমের বন্ধন ঝটিকাসফরে।
কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের পদ্মপুকুর, ঘড়িলাল, জোড়সিং, আংটিহারা, চরামুখা, হরিহরপুর, বেদকাশী থেকে প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে ছেড়ে আসা ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা ট্রলারগুলো সকাল ৯টার মধ্যে শ্যামনগর উপজেলার বৃহত্তর নওয়াঁবেকী বাজার পর্যন্ত এসে পৌঁছায়। আনুমানিক ২০ কিলোমিটার পথের এই নৌরুটে নদী পথে নৌকা ও ট্রলার যোগে চলাচল করতে হয়।কারণ এখানে চলাচলের জন্য কোন বড় সেতু নেই, দু’টি বড় সেতুর সংযোগ হলে ২০কিলোমিটার জুড়ে আনুমানিক ১৫/২০ লক্ষ লোকজনের যাতায়াতের পথচলার সুযোগ হবে। কারণ নওয়াঁবেকী বাজার অত্র অঞ্চলের সর্ববৃহৎ হাটবাজার। যা শ্যামনগর, আশাশুনি, কয়রাসহ আশেপাশের এলাকার সাধারণ মানুষের হাটবাজারের মিলনস্থল। কথিত রয়েছে রাজা প্রতাপাদিত্যর ও নকিপুর জমিদার হরিচরণ রায় বাহাদুরের আমলে সুপ্রতিষ্ঠিত নওয়াঁবেকী হাটখোলা।প্রতি বুধবার নির্দিষ্ট দিনের হাট প্রচলিত হলেও এখন দৈনন্দিন বাজার রুপান্তরিত হয়েছে। যুগ বদলেছে, সমাজ বদলেছে, রাষ্ট্র বদলেছে সেইসাথে কালের আধুনিক পরিক্রমায় রাষ্ট্রের উন্নতি ঘটেছে। খোলপেটুয়া নদীর তীরে এই ঐতিহাসিক হাট বাজার আবহমান কাল ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সমহিমায়। প্রতিদিন শতশত নৌকা ও ট্রলারে করে মানুষজন যাতায়াত করে থাকে। কয়রা উপজেলা থেকে আসার প্রতিমধ্যে বেদকাশী কাশীঁর হাটখোলা, জেলিয়াখালী, গাবুরা চৌদ্দরশি হাটখোলা, পাতাখালী, দুর্গাবাটী, ঝাঁপা, কুপট, কামালকাটী, গড় পদ্মপুকুর, পাখিমারা খেয়াঘাট অতিক্রম করেই নওয়াঁবেকী বাজার। এই নামগুলোই রাজা প্রতাপাদিত্যর শাসনামলে নামকরণ করা যা আজও কালের স্বমহিমায় চলছে।কপোতাক্ষ নদের কোলজুড়ে বিস্তৃত কয়রা উপজেলা এবং খোলপেটুয়া নদীর কোলজুড়ে বিস্তৃত শ্যামনগর উপজেলার এক অপূর্ব মিলন যা আজও বহমান। বঙ্গোপসাগরের জলরাশি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যনগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন এর মধ্যে দিয়ে ভেদ করে কপোতাক্ষ নদ ও খোলপেটুয়া নদীর মোহনায় এসে মিশে।দুর্দান্ত ও প্রচন্ড গতির জলোরাশির জোয়ার ভাটায় নদ ও নদীর এককূল গড়ে আর অন্য কূল ভাঙ্গে। ভাঙা গড়া নিয়েইতো বিশ্বব্রক্ষ্মান্ড ও সংসারের নিয়ম। প্রকৃতির অপূর্ব সৃষ্টি, এ এক চিরন্তন সত্য। কপোতাক্ষ নদ এবং খোলপেটুয়া নদীর বক্ষে গড়ে উঠা জনপদের মাঝে প্রকৃতির নির্মম নিষ্ঠুর পরিহাস দেখা মেলে। প্রাকৃতিক ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, ঝড়বৃষ্টি এ জনপদের নিত্যদিনের সঙ্গীসাথী। এরই মাঝে সুখ দুঃখ শান্তি সম্প্রীতি নিয়েই বসবাস তাদের।ভয়ভীতি উপেক্ষা করে বানের জলে ভেসে যেতে হয়। সাথে মনুষ্য সৃষ্টির প্রাকৃতিক নানা বিপর্যয়ও এর জন্য দায়ী।ওয়াপদা রাস্তা ভেঙে মাঝেমধ্যে বিপুল জলরাশি এলাকায় প্রবেশ করলে ক্ষয়ক্ষতির সীমা থাকেনা। আবাসস্থল, চিংড়ী মৎস্যঘের প্লাবিত হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে মৎস্য নির্ভর অত্র জনপদ। অত্র জনপদে সনাতনী হিন্দু এবং মুসলিম মিলেমিশে সম্প্রীতির সহিত বসবাস করে আসছে, আছে তাদের নির্জস্ব সংস্কৃতি ও ভ্রাতৃত্ব। সনাতনী হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, আদিবাসী, মুন্ডা, কোলসহ কাহার, ঋষি সম্প্রদায়ের লোকজনদের রয়েছে নির্জস্ব ভাষা, সংস্কৃতি,আঞ্চলিকতা ও সম্প্রদায়। এখানকার বৃহত্তর উৎসব অনুষ্ঠানের মধ্যে হিন্দু ধর্মের শারদীয়া দূর্গাপূজা, বাসন্তীপূজা, কালিপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা, দেউল উৎসব, মনসা পূজা, বনবিবি পূজা এবং মুসলিম ধর্মের ঈদ ব্যাপক সমাগমের সহিত পালিত হয়ে থাকে। অধিকাংশ লোকজনই মধ্যবিত্ত পরিবার নিয়ে জন্মলগ্নে বেড়ে ওঠা মানুষজন অধিক পরিমান সরলসোজা কিন্তু ক্রিটিক্যালও বটে।এতসব কথাগুলো যখন লিখছিলাম তখন পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্রের মিল খুঁঝে পাওয়া গিয়েছে এই লেখনীর দর্শনের মাঝে। এখানে নদ নদীর জোয়ার ভাটার তালের সাথে তাল মিলিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে খেটে খাওয়া দিন এনে দিন খাওয়া অসহায় মানুষজন। হ্যাঁ, জেলে সম্প্রদায়ের মানুষের কথাই বলছি, নদীতে রেণুপোনা সংগ্রহ,মাছ ধরে তাদের নিত্যনৈমত্তিক জীবন জীবিকা নির্বাহ হয়।কিন্তু তাদের ভাগ্যের চাকা পরিবর্তন হয়নি। তাদের ভাষ্যমতে,কোন রকমে মাথা গোঁজার একামাত্র ঠাঁই আবাসস্থলটি সুরক্ষার জন্য নিরাপদ বেড়ীবাঁধ কিংবা দীর্ঘস্হায়ী টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রয়োজন, সেটি বাস্তবায়ন চাই। মাঝেমধ্যে তারা সংগঠন সৃষ্টি করে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম, মিছিল,মিটিং ও মানববন্ধন করে প্রশাসন, সরকার, জাতিসংঘের কাছে তাদের আবেদন জানান।ফলপ্রসূ সরকারী উদ্দোগে কিছুটা পরিবর্তন আসলেও এখানকার অনেক মানুষের ক্ষমতা, চরিত্র ও মনুষ্যত্বের পরিবর্তন এখনও আসেনি। অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও সরকারী টাকা মেরে খাওয়ার ধান্ধা গুটিকয়েক সমাজসেবক নামের কলঙ্কিত নামাঙ্কিত ব্যাক্তিবর্গের। যাদের কারণে অত্র এলাকার বেড়ীবাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজের ধীরগতি ও মন্থর। তবে সদাশীল আওয়ামী লীগ সরকার এই মুহূর্তে কঠিন পদক্ষেপ নিয়েছে অত্র এলাকার জনপদ সুরক্ষার জন্য। বেড়িবাঁধ সুরক্ষা প্রকল্পে সরকারি ও বিদেশী দাতাদের অর্থায়নে কোন অনিয়ম ঘটলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। ইতোপূর্বে নদীবিধৌত দক্ষিণাঞ্চলে বড় কোন প্রকল্প গ্রহন না করলেও, জনবান্ধব সরকার দক্ষিণ অঞ্চলের উন্নয়নে কয়েকহাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। আগামীতে বেশ কয়েকটি বড় সেতু নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছে সরকার। সারাদেশের উন্নয়নের চিত্র যখন পাল্টে যাচ্ছে সেইসাথে দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষ হিসেবে আমরাও এই উন্নয়নের অংশীদার হতে চাই। দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যাবস্হা আরো উন্নত করা হোক, মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি। সরকারের সিংহভাগ রাজস্ব আয় আসে সুন্দরবন এবং মৎস্য রপ্তানি থেকে। মৎস্য রপ্তানিতে আয়ের অধিকাংশ উৎস দক্ষিণাঞ্চলের সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাটজুড়ে। এখানে আগের তুলনায় এগিয়ে গেছে, সমৃদ্ধশালী হয়েছে জনপদ ও মানুষের জীবনমানের হালচিত্র। গড়ে উঠেছে কাঁকড়া, চিংড়ি, কুচের রপ্তানির ফ্যাক্টারী ও ফিস ফ্যাকেটিং। দেশীয় শিল্পের সাথে সাথে বিদেশী বিনিয়োগ ও অর্থায়নে আরো বেশি ফ্যাক্টারী, শিল্প ফ্যাকেটিং, শিল্প নগরী, চিংড়ি ও মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র গড়ে উঠলে জেলেসহ নি¤œ মধ্যবিত্ত ও গরীব অসহায় মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে। শিক্ষিত ও বেকারত্বের অবসান হবে চাকরি সৃষ্টির কর্মসংস্থান দিয়ে।এখানে সরকারী উদ্দ্যোগে শিক্ষিত ও বেকারদের
উদ্দ্যোক্তা হিসেবে প্রশিক্ষণ দিয়ে চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষের জন্য বিশেষ ঋণ দিয়ে প্রকল্প সৃষ্টি করতে সহায়তা করা উচিৎ। যারা নিজেরাই আত্মকর্মসংস্থান ও স্বাবলম্বী হতে পারে।তাহলে নদীতে যারা ঝড়বৃষ্টি, শীত উপেক্ষা করে হাড়ভাঙা খাটুনি করে দিন এনে দিন খায়, তাদের কষ্ট কিছুটা লাঘব হবে এসব কর্মসংস্থান এর মাধ্যমে। কারণ শিল্পাঞ্চল, মৎস্য ফ্যাক্টারী কিংবা উদ্দ্যোক্তা সৃষ্টি হলে সেখানখার পর্যাপ্ত পরিমাণে জনবল দরকার হবে, তখন তাদের চাকরির জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। অসহায় জেলে, বাওয়ালী, মৌয়ালী ও নদীর তীরবর্তী মানুষের জীবনমান দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণ করেই এতগুলো লেখনীর মাধ্যমে একটু লেখার প্রয়াস মাত্র।লিখতে লিখতে যখন আমার বাড়ির পাশে টুঙ্গিপাড়া ও দূর্গাবাটী ট্রলার ঘাটে নামছিলাম তখন কর্দমাক্ত মাটিতে পা রাখতেই এ মাটির সাথে ভালোবাসার যে আত্মিক সম্পর্ক তার অনুভূতিটুকু উপলব্ধি করতে পারলাম। এ যেন আবহমান বাংলার রুপ বৈচিত্র্য, কালের স্বাক্ষী হয়ে আছে এসব অঞ্চলগুলো। অনেক স্হাপনা হারিয়ে গেছে কালের গহীনতলে, কিন্তু অত্র জনপদের লোকগাথা গল্প ও কাহিনী থেকে হারিয়ে যায়নি সভ্যতার এসব আঞ্চলিকতা ও সংস্কৃতি।সভ্যতা ও সংস্কৃতির যুগপট পরিবর্তনে এ অঞ্চলের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।ততকালীন বারভূঁইয়ার প্রতাপশালী রাজা প্রতাপাদিত্যর রাজধানী শ্যামনগরের ধূমঘাটেই ছিলো। রাজার রাজধানীর এখান থেকেই শাসন করা হতো বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা জুড়ে নদী ও সমুদ্র অঞ্চলজুড়ে। তিনি এখানে আদি যমুনা নদীর পূর্ব পাড় এবং খুলনা শিবসা নদীর পশ্চিমপাড় জুড়ে ষোলআনা সমাজশাসিত সমাজব্যবস্থা চালু করেছিলেন, যা অত্র নৌঅঞ্চলজুড়ে সমাজ শাসনব্যবস্থা’র ব্যাপক বিস্তৃত ছিলো। তিনি বংশীয় ঘরের হাতেগোনা ব্যাক্তিবিশেষ সমাজের মানুষের কর্মপদক্ষেপ, অবস্থান ও গুরুত্ব বিবেচনা করে তালিকা প্রণয়ন করে তাদের দ্বারাই ততকালীন সমাজ শাসিত শাসনব্যবস্হা’র প্রচলন করেছিলেন। এখন সে সমাজব্যবস্থা বিলুপ্ত প্রায়, তবে তারই বহিঃপ্রকাশ ও আধুনিকতায় বর্তমান সমাজ, রাষ্ট্র ব্যবস্থা বহমান, আবহমান কালের চিত্র।
প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পর্কের সাথে ভালোবাসা থাকলে সৃষ্টি ও স্রষ্টার গূঢ় রহস্য সম্পর্কে জানা যায়। কিন্তু সম্যক সীমাহীন জ্ঞান লাভ করতে না পারলেও কিছুটা অনুধাবন কিংবা উপলব্ধি করা যায় মাত্র।
তাই আসুন প্রকৃতি ও পরিবেশকে ভালোবাসি স্রষ্টার সৃষ্টির সাথে তালমিলিয়ে আমরা সকলেই সৃষ্টিশীল কাজে নিজেকেই আবদ্ধ রাখি।প্রকৃতি ও পরিবেশকে ভারসাম্য ও ভালো রাখলে স্রষ্টার আশীর্বাদে আমরাও সৃষ্টিকূল ভালো থাকবো।