বিশেষ প্রতিনিধি ::
সাতক্ষীরার চারটি নির্বাচনী আসনের মধ্যে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু সাতক্ষীরা-২ (সদর) আসন । এই আসন থেকে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে নৌকা প্রত্যাহারের পরও লাঙ্গলের জয় নিয়ে বেশ টেনশন শুরু হয়েছে দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে। গতবারের নৌকার প্রার্থী মীর মোস্তাক আহমেদ রবি এবার নৌকা না পেয়ে হয়েছেন স্বতন্ত্রপ্রার্থী। তার প্রতিক ঈগল। এই আসনে নৌকার প্রার্থী সরিয়ে নেয়ার পর ৭ জন প্রার্থী নির্বাচনী মাঠে থাকলেও মূলত: ভোট যুদ্ধ হবে লাঙ্গল ও ঈগল প্রার্থীর মধ্যেই। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ইতোমধ্যে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে মাঠে নেমেছে। সাধারন ভোটাররা মনে করছে এবার জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো: আশরাফুজ্জামান আশু ও স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর মোস্তাক আহমেদ রবির মধ্যে লড়াই হবে হাড্ডা-হাড্ডি।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত সাতক্ষীরা-২ (সদর) আসন। ১৩৮টি ভোট কেন্দ্রে মোট ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৬০৮ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৯৯ হাজার ২১৭জন, মহিলা ভোটার রয়েছে ২ লাখ ১ হাজার ৩৮৮ জন এবং হিজড়া ভোটার রয়েছে ৩ জন।
জনপ্রিয়তা হারানোসহ বিভিন্ন কারণে এবার সারাদেশে যে ৩ জন মন্ত্রী ও ৬৬জন এমপি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন থেকে ছিটকে পড়েন তাদের মধ্যে সাতক্ষীরা-২ (সদর) আসনে মীর মোসস্তাক আহমেদ রবি রয়েছেন। দলীয় হাইকমান্ড থেকে সাতক্ষীরা সদর আসনে ক্লিন ইমেজ ও এলাকায় অধিকতর জনপ্রিয়, সাতক্ষীরা সদর উপজেলা পরিষদের টানা দুই বারের নির্বাচিত উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ন-সম্পাদক মো: আসাদুজ্জামান বাবুকে নৌকার প্রার্থী ঘোষনা দেয় । তিনি উপজেলা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়ান। তরুন এই আওয়ামী লীগ নেতা দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পর হাফ ছেড়ে বাঁচেন ভুক্তভোগী অসংখ্য সাধারণ মানুষ। কিন্তু মহাজোটের আসন ভাগাভাগির জাতাকলে পড়ে চূড়ান্তভাবে সাতক্ষীরা সদর আসন শেষ পর্যন্ত তুলে দেওয়া হয় জাতীয় পার্টির হাতে। রংপুরের পরেই একসময় দলটির শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল এই সাতক্ষীরা। ৯০-এর গণআন্দোলনে সরকার পতনের পর দেশের বিভিন্নস্থানে জাতীয় পার্টি কোণঠাসা হয়ে পড়লেও সাতক্ষীরায় তার প্রভাব পড়ে কম। ফলে পরবর্তী নির্বাচনগুলিতে জাতীয় পার্টি বড় দলগুলোর মতোই ভালো ফল করে জেলার আসনগুলোতে।
বিএনপি-জামায়াত জোটের বিপরীতে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টির মহাজোট নির্বাচন করে। এই নির্বাচনে সাতক্ষীরা সদর আসনে মহাজোটের টিকিট পান জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এ জব্বার। তিনি ১ লাখ ৩৩ হাজার ৪২২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। বিএনপি-জামায়াত জোটের মাওলানা আব্দুল খালেক মন্ডল পান ১ লাখ ১৪ হাজার ৫৫৭ ভোট। অর্থাৎ সাতক্ষীরা সদর আসনে জাতীয় পার্টির একটি ভোট ব্যাংক আগে থেকেই রয়েছে।
এসব বিষয় বিবেচনা রেখেই মহাজোটের আসন সমঝোতায় জাতীয় পার্টি জেলার দুটি আসন পাওয়ার জন্য জোর তৎপরতা অব্যাহত রাখলেও শেষ মুহূর্তে তাদেরকে দেওয়া হয় সাতক্ষীরা-২ (সদর) আসন। প্রার্থী হন জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক আশরাফুজ্জামান আশু। তিনি সাতক্ষীরা ভোমরা স্থলবন্দর সিএন্ডএফ এজেন্ট এসাসিয়েশনের সাবেক সভাপতি, সাতক্ষীরা জেলা ক্রীড়া সংস্থার দীর্ঘদিনের সহ-সভাপতি, সাতক্ষীরা চেম্বার অব কমার্সের সাবেক পরিচালকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেন।
এই আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন ২০১৪ ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতিক নিয়ে নির্বাচিত বর্তমান সংসদ সদস্য, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মীর মোস্তাক আহমেদ রবি।
এছাড়া এই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মো. আফসার আলী, তৃণমূল বিএনপির মোস্তফা ফারহান মেহেদী, বিএনএম এর মো. কামরুজ্জামান বুলু, এনপিপির মো. আনোয়ার হোসেন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ইনসান বাহার বুলবুল। তবে এসব প্রার্থী নির্বাচনী মাঠে তেমন কোন আলোচনায় আসতে পারেনি।
নৌকার প্রার্থী আসাদুজ্জামান বাবু মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পর এই আসনে নতুন করে শুরু হয় হিসেব-নিকেশ। সবকিছুই যেন দ্রুত পাল্টাতে থাকে। নৌকা প্রত্যাহারের পর কয়েকদিন কোন শব্দ ছিলনা নির্বাচনী মাঠে। কারন নৌকার প্রার্থী আসাদুজ্জামান বাবু অল্পদিনেই এতোটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন যে, তিনি প্রর্থী হলে এই আসনে তার সাথে কোন প্রতিদ্বন্দ্রিতা হওয়ার সম্ভবনা ছিল না। বাবু টানা দুই বার সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে সাধারন মানুষের দৌড়গোড়ায় পৌঁছে যান। উপজেলা পরিষদ চেয়াম্যান পদ ছেড়েই তিনি এবার নৌকার মাঝি হয়েছিলেন। নৌকা প্রতীক প্রত্যাহার করে নেয়ায় দলীয় নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা বেশ হতাশ হয়ে পড়েন। অনেককে কান্নায় ভঙ্গে পড়তে দেখা যায়।
নানা ক্ষোভ-বিক্ষোভের পরও সম্প্রতি সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো: নজরুল ইসলাম ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ন-সম্পাদক মো: আসাদুজ্জামান বাবু, সরদ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুর রশিদ, সাধারন সম্পাদক শাহাজাহান আলী ও তাদের অনুসারীরা লাঙ্গলের পক্ষে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশই লাঙ্গলের প্রার্থীকে জয়ী করতে মরিয়া।
আওয়ামী লীগের অপর একটি গ্রুপ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী আক্তার হোসেন, সাতক্ষীরা পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ নাসের, সাধারন সম্পাদক শাহাদাৎ হোসেন, জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সম্পাদিকা জোৎনা আরা ও তাদের অনুসারীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর মোস্তাক আহমেদ রবি’র ঈগল প্রতিকের পক্ষে জোর প্রচারে নেমেছে। ফলে রবির জয়ের সম্ভবনা দিন দিন জোরালো হচ্ছে। এছাড়া স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, শিক্ষক পরিষদ, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এদের কেউ লাঙ্গল আবার কেউবা ঈগলের পক্ষে কাজ করছে।
নির্বাচনী মাঠ পর্যবেক্ষন ও সাধারন ভোটারদের সাথে কথা বলে জানাগেছে, আশু আর রবির মধ্যেই এবার হাড্ডা-হাড্ডি লড়াই হবে। নৌকার প্রার্থী প্রত্যাহারের পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ায় লাঙ্গলের জয় নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে সংশয়। দিন দিন রবির পাল্লা যেন বারি হচ্ছে।
তরুন আওয়ামী লীগ নেতা আসাদুজ্জামান বাবু বলেন, আমার নেত্রী আমাকে নৌকার মাঝি করে পাঠিয়ে ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছাড়তে হয়েছে।আমি ভিষন কষ্ট পেয়েছি। আমার দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা সাঙ্গাতিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। তার পরও দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা যে নির্দেশনা দিয়েছে আমি তার বাইরে নয়। মহাজোট প্রার্থী আশরাফুজ্জামান আশুকে জয়ী করতে মাঠে নেমেছি।
সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক মো: নজরুল ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনার বাইরে কাউকে সমাথৃন দেয়া বা কাজ করার কোন সুযোগ নেই।লাঙ্গলের পক্ষেই আমাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-কর্মী স্বতন্ত্র প্রার্থী মীর মোস্তাক আহমেদ রবির পক্ষে কাজ করছে। এটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।
এদিকে, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী আক্তার হোসেন বলেন, দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা বলেছেন এবারের নির্বাচনে নেতা-কর্মীরা যাকে ইচ্ছে সমর্থন দিতে পারবেন। মীর মোস্তাক আহমেদ রবি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। আমরা একজন মুক্তিযোদ্ধার পক্ষেই মাঠে নেমেছি। নৌকার ভোট লাঙ্গলে কেই দেবে না। জয় আমাদের হবেই।
স্বতন্ত্রী প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মীর মোস্তাক আহমেদ রবি বলেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে আমি নৌকা প্রতীক নিয়ে এমপি হয়েছি। এবার নৌকা না পেয়ে হয়েছি স্বতন্ত্র প্রার্থী । আমার কিছু অসমাপ্ত কাজ রয়ে গেছে। এগুলো করতে চাই। সাধারন মানুষের ভাগ্যউন্নয়নে কাজ করেছি। স্থানীয় নৌকা প্রত্যাহার করে নেয়ায় আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ আমার সাথে রয়েছে। আমার বিশ্বাস আমি আবারও এমপি নির্বাচিত হবো।
জাতীয় পার্টির প্রার্থী আশরাফুজ্জামান আশু বলেন, সাতক্ষীরা সদরে জাতীয় পার্টির একটি শক্ত অবস্থান রয়েছে। এর সাথে আওয়ামী লীগের বড় অংশ সমর্থন দিয়েছে। এছাড়া বিগত ১০ বছর যিনি এই আসনে এমপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তাকে নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। সাধারন ভোটাররা তার ধারে পাশে যেতে পারেনি। মানুষ লাঙ্গলে ভোট দেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে বসে আছে। জয়ের ব্যাপারে আমি শত ভাগ আশাবাদি। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার পরিস্কার নির্দেশনা থাকার পরও স্থানীয় আওয়ামী লীগের কিছু নেতা আমার বিরোধীতা করছে। এটা দু:খজনক। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, যদি আওয়ামী লীগের নেতারাই আমার বিরোধীতা করেন তাহলে মহাজোট করার মানে কি ?
##