অনলাইন ডেস্ক ::
কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগমের পরাজয় নিয়ে জেলার সর্বত্র আলোচনা চলছে। আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী তিনবারের সংসদ সদস্য মমতাজের পরাজয়ের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে নিজ উপজেলায় ভোট কম পাওয়া, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও দলীয় নেতাকর্মীর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি এবং বিজয়ী প্রার্থীর বিপুল অর্থ।
নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মানিকগঞ্জ-২ আসনে (সিংগাইর-হরিরামপুর-সদরের ৩ ইউনিয়ন) মমতাজ বেগম ভোট পেয়েছেন ৮২ হাজার ১৩৮টি। এর মধ্যে নিজ উপজেলা সিংগাইরে পেয়েছেন ৩৯ হাজার ৭৮৪ ভোট এবং হরিরামপুর ও মানিকগঞ্জ সদরের তিনটি ইউনিয়নে ভোট পেয়েছেন ৪২ হাজার ৩৫৪টি। পক্ষান্তরে বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান জাহিদ আহমেদ টুলু সিংগাইর উপজেলায় ভোট পেয়েছেন ৬০ হাজার ৫২৮টি এবং হরিরামপুর ও মানিকগঞ্জ সদরের তিনটি ইউনিয়নে পেয়েছেন ২৭ হাজার ৭৮১ ভোট। অর্থাৎ মোট ভোট পান ৮৮ হাজার ৩০৯টি। ফলে ৬ হাজার ১৭১ ভোটে মমতাজ পরাজিত হন।
দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন মমতাজ। এর আগে নবম জাতীয় সংসদে তিনি ছিলেন সংরক্ষিত আসনের সদস্য। তারও আগে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও মমতাজের বেশ জনপ্রিয়তা ছিল। রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না থাকলেও এই জনপ্রিয়তার কারণেই আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পছন্দে তিনি পরপর নৌকার মনোনয়ন পান।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও সাধারণ কর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে মমতাজ এলাকায় এমনিতেই জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর জনপ্রিয়তায় নিজেরাও গর্বিত ছিলেন। যে কারণে মমতাজ যখন রাজনীতিতে সরাসরি অংশ নেন তখনও তাঁকে স্বাগত জানান এলাকাবাসী। কিন্তু সিংগাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন না করে পছন্দের লোকজনকে নিয়ে পাল্লা ভারী করেন। দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁর আত্মীয় শহিদুর রহমানকে। পাশাপাশি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে দলের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল শহিদুরকে। এ ছাড়া সৎ ছেলে আবু নঈম বাশারকে দলের মনোনয়ন দিয়ে সিংগাইর পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত করেন। এসব কারণে রাজনীতির কঠিন পথে একসময় দিক হারিয়ে ফেলেন মমতাজ। দলের পরীক্ষিত নেতাকর্মীর সঙ্গে তাঁর দূরত্ব দিন দিন বাড়তে থাকে।
সর্বশেষ দেখা গেছে বিরোধের কারণে আওয়ামী লীগের পুরোনো নেতা কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক দেওয়ান সফিউল আরেফিন টুটুল, সিংগাইর উপজেলা চেয়ারম্যান মুশফিকুর রহমান খান হান্নান, হরিরামপুর উপজেলা চেয়ারম্যান দেওয়ান সাইদুর রহমান, সাবেক মেয়র শাজাহান মীর, সিংগাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মাজেদ খান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সায়েদুর রহমানসহ অধিকাংশ ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের সঙ্গে মমতাজের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
জেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম মহীউদ্দীন সিংগাইর থেকে কম ভোট পাওয়ার পর সংসদ সদস্য মমতাজ মন্তব্য করেছিলেনু ‘দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছি।’ এ কারণে ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যরা মমতাজের ওপর ক্ষুব্ধ হন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মহীউদ্দীনকে উদ্দেশ করে সরাসরি বক্তব্য দিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন মমতাজ, যা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত হয়। এটা মেনে নিতে পারেননি গোলাম মহীউদ্দীনসহ আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতাকর্মী। ফলে এবারের নির্বাচনে গোলাম মহীউদ্দীন পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জাহিদ আহমেদ টুলুকে। এক দিনের জন্যও দলীয় প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে নামেননি মহীউদ্দীন।
এ অবস্থায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মানিকগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের চার নেতা স্বতন্ত্র নির্বাচন করেন। এর মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ বিপুল অর্থসম্পদের অধিকারী টুলু এলাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অর্থসহায়তা দিয়ে আলোচনায় উঠে আসেন। তাঁর সঙ্গে আওয়ামী লীগের জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য, ইউনিয়নসহ তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরাট একটি অংশের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। অর্থের কারণে এর বাইরেও সাধারণ মানুষের মধ্যে ভালো একটা ইমেজ গড়ে তুলতে সমর্থ হন টুলু, যার ফল হয়েছে মমতাজ বেগমের পরাজয়।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম মহীউদ্দীন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে আস্থা রেখে মমতাজকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, সেই জায়গা তিনি রাখতে পারেননি। জনগণের কাছে যেতে পারেননি, নানা ধরনের বদনাম অর্জন করেছেন এবং দলীয় নেতাকর্মীকে অসম্মান করেছেন। এসব কারণেই তাঁর পরাজয় হয়েছে।
এ ব্যাপারে বর্তমান সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম বলেন, সিংগাইর উপজেলার বায়রা ও বলধরা ইউনিয়নে কৌশলে অস্বাভাবিক ভোট কেটে নিয়ে গেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জাহিদ আহমেদ টুলু। ওই দুটি ইউনিয়নে স্বাভাবিক ভোট হলে তাঁর পরাজয় হতো না। এ ছাড়া অর্থের কাছে দলীয় নেতাকর্মীর বিক্রি হয়ে যাওয়াও একটি কারণ।