অনলাইন ডেস্ক ::
একুশের ছুটির আগে মা-বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছে দুই কিশোর-কিশোরী ভাইবোন। বেড়ানোর আনন্দের মধ্যেও তাদের মনে খচখচ করছে একটি কথা। একসময় বোনটি বলেই ফেলল বাবাকে, ‘বাবা, এবার তাহলে আর শহীদ মিনারে যাওয়া হবে না?’ একমুহূর্ত থমকে গেল সবাই। হুঁশ ফিরেই বাবা বলে উঠলেন, ‘২১ ফেব্রুয়ারিতে তুমি যেখানেই যাবে, সেখানেই পাবে শহীদ মিনার।’
শুধু দেশে নয়, পৃথিবীর বহু দেশেই মাথা তুলেছে বাংলাদেশের ভাষাশহীদদের স্মরণের মিনার। বাঙালিরা যেখানেই গেছে, বুকের মধ্যে করে নিয়ে গেছে শহীদ মিনারের আবেগ। ফ্রান্স বিশ্বকে দিয়েছে সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার ধারণা; রাশিয়া বিশ্বকে দিয়েছে শ্রমিক বিপ্লবের উদাহরণ; আর বাংলাদেশ বিশ্বকে দিয়েছে ভাষিক ঐক্যের প্রেরণা।
বিশ্বায়িত শহীদ মিনার
জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ বা ন্যাশনাল মনুমেন্ট তো সব দেশেই আছে। আমেরিকায় ভিয়েতনাম মেমোরিয়াল খুবই প্রভাবশালী। ইউরোপে আছে হলোকস্ট মেমোরিয়াল। পশ্চিমা দুনিয়ার আরও দুটি বিখ্যাত স্থাপনা হলো নিউইয়র্কের স্ট্যাচু অব লিবার্টি এবং প্যারিসের আইফেল টাওয়ার। বাংলাদেশের শহীদ মিনার সেসবের মধ্যে আলাদা করে চোখে পড়ে। পৃথিবীর আর কোনো দেশে আর কোনো জাতীয় ঘটনার স্মরণে একই আদলের এত বেশি স্থাপত্য বা স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হয়নি। ধর্মীয় উপাসনা কেন্দ্র ছাড়া আর কোনো সাংস্কৃতিক প্রতীককে এত বেশি ভালোবাসাও দেয় না কোনো জাতি। একই দিনে বহু দেশে একসঙ্গে সাংস্কৃতিক জমায়েতও আর হয় না। পৃথিবীর যেখানেই বাঙালি রয়েছে, সেখানেই একের পর এক মাথা তুলছে বাংলাদেশ থেকে ছড়িয়ে পড়া শহীদ মিনারের আদল।
২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে বিশ্বের ১৮৮টি দেশে দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা শুরু হয়। জাতিসংঘের স্বীকৃতির আগেই অনেক দেশের অনেক শহরে মাথা তুলেছে ভাষাশহীদদের স্মরণের এই মিনার। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়, ঝাড়খন্ড ও ছত্তিশগড়ের বিভিন্ন জনপদে বাংলাদেশের ভাষাশহীদদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে শহীদ মিনার।
পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় ও সুন্দর শহীদ মিনারের সুখ্যাতি পেয়েছে বশিরহাটের টাকির শহীদ মিনার। বেলেঘাটা ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েও রয়েছে ভাষাশহীদদের স্মৃতির মিনার। বাংলাদেশের শহীদ মিনারের আদলে শহীদ মিনার রয়েছে কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কে, কলকাতার বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনে, ভাষাশহীদ উদ্যানে, মধ্যমগ্রামের চৌরাস্তায়, সীমান্ত-শহর হরিদাসপুরে, উত্তর চব্বিশ পরগনার বশিরহাটে, পঞ্চসায়র নেতাজি সুভাষ হোটেল ম্যানেজমেন্ট কলেজসহ নানা জায়গায়।
উপমহাদেশের বাইরে যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, জাপান, পর্তুগাল, অস্ট্রেলিয়া, ওমান এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটনসহ কয়েকটি শহরে এক বা একাধিক শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছে। ২০২১ সালে দক্ষিণ ফ্রান্সের তুলুজ শহরে মাথা তুলেছে নতুন এক শহীদ মিনার। এটি ফ্রান্সের প্রথম শহীদ মিনার। প্যারিসেও চলছে আরেকটি শহীদ মিনার তৈরির কাজ। কানাডার ম্যানিটোবা প্রদেশের রাজধানী উইনিপেগে দেখা যাবে ঢাকার জাতীয় শহীদ মিনারের আদলে নির্মিত মাতৃভাষা প্লাজা। দেশটির বাণিজ্যিক রাজধানী টরন্টোর ডেনটোনিয়া পার্কে নির্মিত হয়েছে আরেকটি স্থায়ী শহীদ মিনার।
জার্মানি, রাশিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য সেসব দেশের প্রশাসন ও স্থানীয় সরকারের সঙ্গে প্রবাসী বাঙালিদের আলোচনা ও প্রস্তুতির খবর পাওয়া গেছে। তবে এর প্রকৃত সংখ্যা এখনও নিরূপণ করা হয়নি।
নতমুখ, সহজিয়া কিন্তু সটান শিরদাঁড়া
বাংলাদেশের জাতীয় চেতনার অন্যতম উৎস শহীদ মিনার। কিন্তু বাংলা ভাষার অধিকারের চেতনাবাহী এই শব্দযুগল কিন্তু আরবি ও উর্দু থেকে আসা। রাষ্ট্রভাষা দাবির ভাষাও কৃষকের ভাবব্যাকরণে গঠিত। ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ কিংবা ‘ওরে বাঙালি ঢাকার শহর রক্তে রাঙাইলি’ গানগুলো বলে আঞ্চলিক বাংলা দরবারি বাংলার চাইতে শক্তিশালী। আট ফাল্গুনের বদলে একুশে ফেব্রুয়ারি, স্মৃতিসৌধ না বলে শহীদ মিনার করা দিয়ে বোঝায় ভাষাবিদ্বেষ নয়, জাতিবিদ্বেষ নয়, ধর্মবিদ্বেষ নয়, বরং সর্বভাষার সর্বজনের অধিকারের কথাই বলবে শহীদ মিনার। সটান শিরদাঁড়া, তবু নতমুখ ভঙ্গিমা দিয়ে এ বলে, জাতীয়তাবাদের উদ্ধত গর্ব এ নেবে না। মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় স্মৃতিসৌধ মহাকাব্যিক, আর শহীদ মিনার লোকগানের মতোই সহজিয়া। জাতীয় স্মৃতিসৌধ মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের প্রতীক আর শহীদ মিনার দেশের রোরুদ্যমান আত্মার প্রতীক। জাতীয় স্মৃতিসৌধ রাষ্ট্রিক, শহীদ মিনার সামাজিক। জাতীয় স্মৃতিসৌধ দৈশিক, এর অংশী বিশ্বের বাঙালিরা; শহীদ মিনার বৈশ্বিক, এটা সর্বজাতির ভাষিক অধিকারের প্রতীক।
একুশের জমায়েতে অংশ নিতে পারে সব ধর্ম, জাতি, ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতির মানুষ। ভাষা আন্দোলনের এই মহিমার কারণেই সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ও প্রধান বিচারপতি প্রয়াত মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি সকল ভাষার কথা কয়।’ জাতির ভালোবাসার সন্তানদের শেষ বিদায়ের স্থানও শহীদ মিনার। এ ছাড়া আন্দোলনে-প্রতিবাদে-শপথে সারা বছরই জীবন্ত থাকে শহীদ মিনারের চত্বর।
জাতির প্রাণভোমরা
সারাদেশের শহীদ মিনারগুলোর বেশির ভাগই তৈরি হয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্থানীয় উদ্যোগে। কোনো প্রণোদনায় মুখাপেক্ষী থাকেনি। এখন যাতে সব সরকারি বিদ্যালয়ের শহীদ মিনার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে তৈরি করা হয়, সে জন্য সরকারি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এর নির্মাণযোগ্য নকশা তৈরি করছে গণপূর্ত বিভাগ।
১৯৫২ সালের প্রথম শহীদ মিনারটি ভেঙে দিয়েছিল তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। এর নকশা করেছিলেন ভাষাসৈনিক সাঈদ হায়দার। কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ তখন কবিতায় লিখেছিলেন, ‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো/ চার কোটি পরিবার/ খাড়া রয়েছি তো!’
১৯৫৭ সালে শিল্পী হামিদুর রহমান ও ভাস্কর নভেরা আহমদের পরিকল্পনা ও নকশা অনুযায়ী শহীদ মিনার তৈরির কাজ শুরু হয়। ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এর উদ্বোধন করেন বরকতের মা হাসিনা বেগম। এই শহীদ মিনারের আদলটিই পরে সবখানে ছড়িয়ে পড়ে।
এর পরেও আঘাত এসেছে শহীদ মিনারের ওপর। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সেনারা আবার ভেঙে দিয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। স্বাধীনতার পরে আবার নতুন করে গড়ে তোলা হয় শহীদ মিনার। সারাদেশে পাড়ায়, মাঠে, স্কুল-কলেজে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এর অনুকৃতি। দেশজুড়ে প্রতিটি অঞ্চলই হয়ে ওঠে শহীদ মিনারের আঙিনা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আর বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া বাঙালির হাত ধরে শহীদ মিনার এখন বিশ্বজনীন মানবিক প্রতীক।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সূত্রমতে, বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৬৫ হাজার ৬২০টি। এগুলোর মধ্যে প্রায় ২৩ হাজার বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার রয়েছে। আর সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয় সাড়ে ১৯ হাজারের মতো। এগুলোর অনেকটিতেই রয়েছে শহীদ মিনার। বিশ্ববিদ্যালয়, জেলা ও উপজেলা সদর, থানা ও ইউনিয়নের অনেক স্থানেই স্থায়ী শহীদ মিনার দেখা যায়। বেসরকারি অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও রয়েছে শহীদ মিনার। সরকারিভাবে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারণা করা যায়, দেশে স্থায়ী শহীদ মিনারের সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি হবে।
ফি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি এলে সারাদেশে হাজারো অস্থায়ী শহীদ মিনার বানানো হয়। শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীরা বাঁশের বাতা, কাগজ বা ইট দিয়ে আপন মনের আবেগ দিয়ে সেসব গড়ে তোলে ও সাজায়। ঠিক এভাবে বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত প্রহরের দুই দিন পর ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের হাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজে তৈরি হয়েছিল প্রথম শহীদ মিনার। সেই স্মৃতিরই যেন পুনরাবৃত্তি হয় শিশু-কিশোরদের হাতে বানানো অস্থায়ী শহীদ মিনারের আয়োজনে।