অমিত কুমার :
পাটকেলঘাটা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামবাংলার সমৃদ্ধির প্রতীক ধানের গোলা। কৃষি প্রধান বাংলাদেশে এখন প্রায় প্রত্যেক কৃষকের বাড়িতে নতুন ধান ওঠে। মাঠের পর মাঠ ধানক্ষেত থাকলেও অধিকাংশ কৃষকের বাড়িতে নেই ধান মজুদ করে রাখার বাঁশ-বেত ও কাদা দিয়ে তৈরি গোলা বা গোলাঘর। পাটকেলঘাটার কাশিয়াডাঙ্গা গ্রামের আব্দুল্লাহ মোড়ল (৪০) বলেন, আমাদের বাড়িতে ধানের গোলা শুধু স্মৃতি হয়ে আছে। আমাদের গোলা থাকলেও ধান গোলায় রাখার সময় হয় না। ধান উঠার সাথে সাথে দায় দেনার তাগিদে বাজারে বিক্রি করা হয়। একসময় সমাজের নেতৃত্ব নির্ভর করতো কার কয়টি ধানের গোলা আছে এই হিসেব কষে। কন্যা পাত্রস্থ করতেও বর পক্ষের বাড়ি থেকে ধানের গোলার খবর নিতো কনে পক্ষের লোকজন, যা এখন শুধু কল্পনায় ভাবা যায়।
গ্রাম অঞ্চলে বাড়িতে বাড়িতে বাঁশ দিয়ে গোল আকৃতির তৈরি করা ধানের গোলা বসানো হতো মাটি হতে দুই ফুট উঁচুতে। গ্রাম অঞ্চলে বাড়িতে বাড়িতে বাঁশ, বাঁশের বাতা ও কঞ্চি দিয়ে প্রথমে গোল আকৃতির কাঠামো তৈরি করা হত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বর্গ অথবা আয়তক্ষেত্র আকারে গোলা তৈরি করা হত। এরপর তার গায়ের ভেতরে-বাহিরে মাটির আস্তরণ লাগানো হতো। গোলায় শুকানো ধানের চাল হতো শক্ত। কিন্তু সাম্প্রতিককালে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও আধুনিক কলের লাঙ্গল যেন উল্টে-পাল্টে দিয়েছে গ্রাম অঞ্চলের চালচিত্র। গোলায় তোলার মতো ধান আর তাদের থাকে না। গোলার পরিবর্তে কৃষকরা ধান রাখা শুরু করে বাঁশের তৈরি ক্ষুদ্রাকৃতি ডোলে। ধান আবাদের উপকরণ কিনতেই কৃষকের বিস্তর টাকা ফুরায়। কৃষকের ধানের গোলা ও ডোলা এখন শহরের বিত্তশালীদের গুদাম ঘরে পরিণত হয়েছে। কৃষকের ধান চলে যাচ্ছে একশ্রেণীর অসাধু মুনাফালোভী ফড়িয়া ও আড়ত ব্যবসায়ীর দখলে। ইট বালু সিমেন্ট দিয়ে পাকা ইমারত গুদাম ঘরে মজুদ করে রাখা হচ্ছে হাজার হাজার টন ধান চাল। অনেক ক্ষুদ্র কৃষক বস্তা ও ব্যারেল ভর্তি করে রাখছে আউশ, আমন ও বোরো মওসুমে উৎপাদিত ধান চাল। বাস্তবতা বড়ই নিষ্ঠুর। আগামী প্রজন্মের কাছে ধানের গোলা একটি স্মৃতিতে পরিণত হচ্ছে। আধুনিক গুদাম ঘর ধানচাল রাখার জায়গা দখল করছে। ফলে ধানের গোলার ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে এলাকা থেকে।
পাটকেলঘাটার কাশিয়াডাঙ্গা গ্রামের ৮৫ বছরের বৃদ্ধ আনছার আলী মোড়ল বলেন, ‘এই ধান রাখার গোলাঘর আমার দাদার আমলে তৈরি করা হয়েছিল। আমার বাবাও এসব ব্যবহার করে গেছেন। তিনি আরও বলেন আমার বাপ দাদার আমলে আমাদের প্রায় ৫০বিঘা জমি ছিল, বর্তমানে ভাগ বাটোয়ারা করতে করতে জমির পরিমান ১০/১২ বিঘার মধ্যে এসেছে। এতে জমির ধান নিরাপদে রাখতে গোলা বেশ উপকার করে। বালিয়াদহ গ্রামের ৮০বছরের বৃদ্ধ মিয়াজান মোল্যা বলেন আগে অনেক ধান হত এখন সেই পরিমান হয় না , এখন গোলায় ধান নেই, ইরি ধান উঠলে আবার গোলা ভরে যাবে। গোলায় ধান মজুদ রাখলে ধান ভাল থাকে বেশি দামে বিক্রি ও করা যায়। আমতলাডাঙ্গা গ্রামের শাহীনুর রহমান (৩৫) বলেন, এখন আর গোলাঘরের তেমন প্রয়োজন হয় না। জমি থেকে কাটার সঙ্গে সঙ্গেই পাইকাররা ধান কিনে নিয়ে যান। শুধু নিজেদের খাওয়ার জন্য যে পরিমাণ চালের প্রয়োজন, সেই পরিমাণ বুঝে ধান বাড়িতে রাখা হয়। গোলায় ধান রাখলে নষ্ট কম হয় ইদুরে নষ্ট হয় না, তবে এই ধানের গোলা আমাদের পরিবারের স্মৃতি বহন করে। তাই এটি না ভেঙে এভাবেই রেখে দিয়েছি।