রিয়াদ হোসেন ::
হারিয়ে ফেললাম একজন নিভৃতচারী স্বপ্নদ্রষ্টাকে। যার দু’চোখ জুড়ে ছিলো হাজারো রঙিন স্বপ্নের বসবাস। দেশ স্বাধীনের একজন অগ্রনায়কও ছিলেন তিনি। সম্মুখ সারিতে যুদ্ধ করে পাক-হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে এনেছিলেন এই মাতৃভূমিকে। পেশাজীবনে পুরোটা সময়জুড়ে করেছেন সাংবাদিকতা। জীবনের শেষ অব্দি ন্যায়-নীতি আর নৈতিকতায় ছিলেন অটল। তিনি সমাজ, গ্রাম এবং সর্বোপরি দেশকে নিয়ে যে চিন্তা-চেতনা লালন করতেন তা আমার মতো হাজারো পরবর্তী প্রজন্মের প্রতিনিধিদের উজ্জীবিত করতো।
আমার চোখে, সমাজের তথাকথিত মানুষের থেকে তিনি ছিলেন কিছুটা আলাদা। বলা যায়, অনন্য এক ব্যক্তিত্ব নিয়ে জীবন অতিবাহিত করেছেন। শেষ সময়ে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে তার। দেখেছি, তার জন্মস্থান সাতক্ষীরার তালা উপজেলার শাহাজাদপুর গ্রাম নিয়ে তার ভাবনার জগতটি ছিলো অনেক বড়। কি করে এই জনপদের মানুষ স্ব-শিক্ষায় শিক্ষিত হবে; কি করে তারা সমাজ ও দেশের প্রতিটি বিভাগে অবদান রাখবে; কি করে তাদের জীবন মানের উন্নতি ঘটবে এমন সব বিষয়ে তিনি কাজ করতে শুরু করেছিলেন। সমাজকে আলোকিত করার সব ধরনের প্রচেষ্টা ছিলো তার ভিতরে। যে নিভু নিভু প্রদীপের আলোয় তিনি বদলাতে শুরু করেছিলেন পুরো সমাজকে। ধীরে ধীরে পরিবর্তনও আসছিলো তার হাত ধরে। এমন সময় সৃষ্টিকর্তার ডাকে পরপারে পাড়ি দিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক হিরু। ১০ মার্চ দুপুরে খুলনার শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।
ভাবতে পারেন, যে মানুষটার সপ্তাহে দু’বার কিডনিজনিত সমস্যায় রক্তের ডায়ালাইসিস করা লাগতো; তার জীবনে আর কি স্বপ্ন থাকতে পারে? তিনি এই সংকটময় পরিস্থিতিতে কি করে সমাজের পরিবর্তন নিয়ে চিন্তা করতেন? কিভাবে তিনি নিজের বাঁচা-মরার কথা খুব বেশি না ভেবে মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টাটা অব্যহত রাখতেন? কথাগুলো শুধু কাগজে আপনি পড়ছেন আর আমি কলমে লিখেছি এমনটা নয়৷ প্রকৃতপক্ষে এই এ. কে হিরু এমনই একজন মানুষ ছিলেন। নিজেকে আড়াল করে নীরবে নিভৃতে তিনি সারাজীবন কাজ করে গেছেন। সমাজের পরিবর্তন দরকার; গ্রামীণ সমাজে মানুষ হওয়া শিক্ষার্থীদের চিন্তার জগতকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি তাদেরকে এই জনপদ থেকে শিক্ষা-দীক্ষা, সভ্যতায় গড়ে তুলতে তিনি তার সারাটা জীবন উৎসর্গ করেছেন। আলোকিত সমাজ বির্নিমানে তার অবদান ছিলো অনিস্বীকার্য। জনপ্রতিনিধি না হয়েও যে সমাজের জন্য উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখা যায়, সমাজের পরিবর্তনে কাজ করা যায় তারও এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেলেন এ. কে হিরু। কোথাও কখনও তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে দাম্ভিকতা করেছেন এমন তথ্য আজও জানা যায় নি৷ এমনকি নিজেকে সমাজসেবক হিসেবেও তিনি পরিচয় দিতেন না। সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন মানুষটি। সবসময় পিছন থেকে কাজ করার মানসিকতা গড়ে তুলতে পরবর্তী প্রজন্মকে ইতিবাচক মনোভাবে গড়ে উঠার পরামর্শ দিতেন।
মিষ্টভাষী, সদালাপী এবং হৃদয়বান এক মানুষের নাম ছিলো এ.কে হিরু। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় তিনি ছিলেন অতুলনীয়। পেশাদারিত্বের জায়গায় ও নীতির প্রশ্নে কখনও অন্যায়ের সাথে আপোষ করেন নি। সাংবাদিকতা জীবনে সবশেষ কাজ করেছেন চ্যানেল আই’ র খুলনা ব্যুরো হিসেবে। সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনেও এ. কে হিরু ছিলেন অত্যন্ত সোচ্চার একজন ব্যক্তি। যেকোনো সাংবাদিকের চাকরি বা মামলার বিষয়ে তিনি সামনে থেকে এগিয়ে আসতেন। যে কারণে খুলনার সাংবাদিকদের বৃহত্তর সংগঠন খুলনা প্রেসক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন৷ নেতৃত্ব দিয়েছেন খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে। ফলে আপাদমস্তক সাংগঠনিক এই সাংবাদিক অতি শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন সবার কাছে। তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমেছে খুলনার সাংবাদিক সমাজ ও বিশিষ্টজনদের মাঝে।
কর্মজীবনে তিনি সমাজের উন্নয়ন, অগ্রগতির জন্য নানা কাজ করেছেন। নিজের জন্মস্থানে তিনি গড়ে তুলেছিলেন অরাজনৈতিক ও আলোকিত সমাজ বির্নিমানে ‘বিকিরণ’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। যার মাধ্যম দিয়ে স্থানীয় যুবকদের কর্মমুখী প্রশিক্ষণ, নারীদের স্বাবলম্বী করে তুলতে পশু পালন প্রশিক্ষণ, তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে গ্রামের শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে একাধিকবার কম্পিউটার প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করেছিলেন। করোনাকালীন বিকিরণ নামে এই সংগঠনের পক্ষ থেকে সচেতনামূলক পোস্টার বিলি করার পাশাপাশি দু:স্থ, অসহায়দের খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়। নিজের ইউনিয়ন ও পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নে রাস্তাঘাট নির্মাণ, বিদ্যুতায়ন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠনের অবকাঠামগত উন্নয়নে রেখে গেছেন তার পদচিহ্ন। তিনি সবসময় চেয়েছিলেন, তার অসমাপ্ত স্বপ্নগুলো যেন পরবর্তী প্রজন্মের প্রতিনিধিদের দ্বারা বাস্তবায়ন হয়৷ আজ বীর মুক্তিযোদ্ধা এ.কে হিরু সশরীরে বেঁচে নেই। শুধু আছে তার কর্মময় জীবনের স্মৃতিগুলো। তার বাকি স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব আজ আমাদের মতো শতশত তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিদের। তার প্রতিষ্ঠিত সমাজসেবী সংগঠন, দূরের কাছের আত্মীয়স্বজন আর আমাদের মতো অসংখ্য শুভাকাঙ্ক্ষীর হৃদয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন যুগ-যুগান্তর ধরে। সৃষ্টিকর্তার কাছে তার রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। পরপারে ভালো থাকবেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক হিরু। আপনার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলী।
লেখক: সদস্য, বিকিরণ