ডেস্ক রিপোর্ট ::
শ্যামনগরের উপকূলীয় অঞ্চলের নারীর অধিকার আদায়য়ের লক্ষ্যে এবং মানব কল্যাণে ৫ জয়িতার অবদানের কথা এখন মানুষের মুখে মুখে। সংগ্রামী অপ্রতিরোধ্য নারীর প্রতীকী নাম জয়িতা। নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের মূর্ত প্রতীক জয়িতা। কেবল নিজের অদম্য ইচ্ছাকে সম্বল করে চরম প্রতিকূলতাকে জয় করে জয়িতারা তৃণমূল থেকে সবার অলক্ষ্যে সমাজে নিজের জন্য জায়গা করে নিয়েছেন। সরকারের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর এই জয়িতাদের খুঁজে বের করার উদ্যোগ নিয়েছে। উদ্যোগটির নাম ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’। জয়িতাদের পাঁচটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে ১. অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী; ২. শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী; ৩. সফল জননী নারী; ৪. নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন যে নারী; ৫. সমাজ উন্নয়নে অবদান রেখেছেন যে নারী। শ্যামনগর উপজেলায় জয়িতা বাছাই কাজটি পরিচালিত হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বাছাইয়ের কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে পাঁচজন জয়িতাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর মনে করে, জয়িতারা বাংলাদেশের বাতিঘর। জয়িতাদের দেখে অন্য নারীরা অনুপ্রাণিত হলে ঘরে ঘরে জয়িতা সৃষ্টি হবে। আর তা হলেই বাংলাদেশ তার গন্তব্যে পৌঁছে যাবে।
অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারীর নাম শংকরী মন্ডল। শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের কুলতলী গ্রামের শংকরী মন্ডল প্রাাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ কৃষি বাড়ি তেমনই একটি কৃষি পরিবার। স্বামী ও দুই সন্তানসহ চার সদস্যের ছোট্ট সংসার তার। স্বামী প্রশান্ত মন্ডল পেশায় ভ্যানচালক। বড় মেয়ে সুষ্মিতা বালা ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করে চাকরির খোঁজে ব্যস্ত এবং ছোট মেয়ে সংগীতা বালা জেলা শহরে অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্রী। স্বামী দিনের অধিকাংশ সময়ে বাইরে ভ্যান চালানোর কাজ করেন। যদিও স্বামী ও সন্তানদের সহযোগিতায় কৃষি বাড়ির সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করতে হয় তার নিজ হাতেই। ২০২১ সালে অক্টোবর মাসে নেটজ পার্টনারশীপ ফর ডেভেলপমেন্ট জাস্টিস’র সহযোগিতায় পরিবেশ পদকপ্রাপ্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিকের বাস্তবায়নে পরিবেশ প্রকল্প শুরু হলে মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের কুলতলী গ্রামে ধুন্দল সিএসও দলে যুক্ত হয়। যুক্ত হওয়ার পর থেকে তিনি নিয়মিতভাবে সাপ্তাহিক আলোচনায় সভায় অংশগ্রহন করে আসছেন। বারসিক পরিবেশ প্রকল্প থেকে উৎপাদনশীল সম্পদ হিসাবে কৃষি কাজে ব্যবহারের জন্য একটি মোটর, ১টি কদবেল, পেয়ারার চারা, কিছু বীজ, ১টি ছাগল ও দুটি মুরগী সহযোগিতা পান তিনি। বারসিক-এর নিয়মিত আলোচনা, প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও সহযোগিতার মধ্য দিয়ে তিনি নিজের প্রচেষ্টা, শ্রম ও মনোবল দিয়ে পারিবারিক কৃষি পরিচর্যা চলমান রাখেন তিনি।
তিনি মাত্র ১৫শতক বসতভিটায় বছরব্যাপী বৈচিত্র্যময় ফসল চাষাবাদসহ প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ করেন। ফলজ, বনজ, ঔষধীসহ বিভিন্ন চাষাবাদ ও সংরক্ষণ এবং প্রাণীসম্পদ হিসেবে ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন করেন। এছাড়া নিজের মিষ্টি পানির পুকুরে সারা বছর স্থানীয় মৎস্যবৈচিত্র্য কৈ, শিং, মাগুর, মলা, শোল, ঢেলা, চ্যাং, ব্যাদলা, পুটি, মরুল্য, রুই, কাতলা, মৃগেল, তেলাপিয়া, টেংরা, চিংড়ি ইত্যাদি চাষাবাদ ও সংরক্ষণ করেছেন। সুব্যবস্থাপনার জন্য তার কৃষি খামারে সকল ফসলের নাম করণ দিয়ে ছোট সাইনবোর্ড দিয়ে সহায়তা করেছে বারসিক। শংকরী রানী আরও বলেন, ‘তার বসতভিটায় নানা ধরনের ফসল চাষাবাদ করেন, ফলে বাজার থেকে খুব বেশি সবজি ক্রয় করা লাগে না।’ পরিবারের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের মাঝে মাঝে বিনামুল্যে বিনিময় ও বিক্রি করে কিছু টাকা সঞ্চয় করেন। যা কিনা সঞ্চয় জমা, মেয়েদের পড়ালেখার খরচসহ পারিবারিক কাজে ব্যয় করেন। শংকরী রানী নিজে একজন সফল কৃষানী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেনি এর পাশাপাশি তিনি বাল্য বিবাহ বন্ধ করেছেন, স্থানীয় খালে সমবায় ভিত্তিক মৎস্য চাষে যুক্ত হয়ে পরিচিতি লাভ করেছেন। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারী সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে কৃষি বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন এবং সে প্রশিক্ষণ লব্ধ জ্ঞানকে লাগিয়ে জলবায়ু সহিষ্ণু কৃষি খামার গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে তিনি আর্থিক দিক থেকে অনেকটা সাবলম্বী। তার পরিবার বর্তমানে অনেক সুখী। তিনি বিশ্বাস করেন নারী পুরুষ কোন ভেদাভেদ নেই। নারীরা ইচ্ছা করলে অনেক কিছু করতে পারে। তাই তিনি নিজেকে একজন অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী মনে করেন।
শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারীর নাম আঞ্জুয়ারা খাতুন। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ১০নং আটুলিয়া ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের দ: প: আটুলিয়া গ্রামের মো. আমজাদ আলী গাইনের কন্যা আঞ্জুয়ারা খাতুন। তার জীবনে চলার পথ ছিল অনেক কষ্টময়। তার পিতা একজন অত্যন্ত গরীব, অসহায় ও দিনমুজুর ছিলেন এবং আছেন। তিনি স্থানীয় প্রাতমিক বিদ্যালয় থেকে ২০০৮ সালে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা সাধারণ বৃত্তি পেয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে আটুলিয়া আব্দুল কাদের স্কুল এন্ড কলেজে ভর্তি হয়। সেখানে ৮ম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালীন সময়ে তার দাদা তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। বিয়ের পরে তিনি পড়ালেখা করতে চাওয়ায় ও যৌতুক প্রথাসহ পারিকারিক বিভিন্ন কারণে তার ডিভোর্স হয়। ২০১১ সালে সে জেএসসি পাশ করার পর তার অভিভাবক ও গ্রামের মুরব্বীরা মিলে তার সেই স্বামীর সাথে পুনরায় বিয়ে দেয়। কিন্তু তার শ্বশুর বাড়ীতে মনোমালিন্য শুরু হয়। পড়ালেখা করতে নানা বাধা সৃষ্টি হয়। তাই তার স্বামী ও সেগ্রামের একটি সাধারণ বাড়িতে ভাড়া থাকতে শুরু করে। তার স্বামী একজন বাস শ্রমিক। সেখানে অত্যন্ত দারিদ্রতার মধ্য দিয়ে তার স্বামীর অনুপ্রেরনায় ২০২২ সালে সে বিএ অনার্স ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে পাশ করে। তাহার সংসারে ৬বছর বয়সী ১টি পুত্র সন্তান রয়েছে। বর্তমানে সে শ্যামনগর মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ে ইউনিয়ন মহিলা উন্নয়ন কর্মী হিসাবে কর্মরত। তার চাকরি হতে প্রাপ্ত বেতনে স্বামী পুত্র নিয়ে একটি সুখী ও সুন্দর জীবন যাপন করছে। সে একজন আদর্শ জননী ও আদর্শ নাগরিক। সমাজের বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কর্মকান্ডে সে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। নিজের ইচ্ছাশক্তি ও অক্লান্ত পরিশ্রেমের কারনে সে নিজেকে একজন শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী মনে করেন।
সফল জননী নারীর নাম রাবেয়া খাতুন। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ৯নং বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের পশ্চিম পোড়াকাটলা গ্রামে মো. আব্দুস সবুর গাজীর স্ত্রীর রাবেয়া খাতুন। দরিদ্র পরিবারে জন্ম তার। ২২বছর বয়সে তার বিয়ে হবার পর একটি অস্বচ্ছল পরিবারে সংসার যাপন করতে হয়। স্বামীর সীমিত আয়ে কোনভাবে দিন চলে মাত্র। কেননা স্বামী উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হয়। সাংসারিক টানাপোড়নের মাঝে একে একে ৪টি সন্তান জন্ম গ্রহণ করে। সান্তানদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণীতে পড়া চলমান থাকাবস্থায় তার স্বামীর ব্যবসায় লোকসানের কারণে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। সংসারিক ব্যয়, সন্তানদের পড়ালেখার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে থাকে সে। তৎকালীর সময়ে স্কুলে স্কুলে সরকারীভাবে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণকৃত চাল, গম খেয়ে ও পতিত-পরিত্যক্ত কৃষি জমির শাক-সবজি সংগ্রহ করে দিন ন্যুনতমভাবে চলতে থাকে তার। তাছাড়া হাঁস-মুরগী, ছাগল-ভেঁড়া পালনের মাধ্যমে সাংসারিক সম্পূরক ব্যয় মিটাতে থাকে এবং উক্ত সময়ে ঘর্ণিঝড় আইলায় সবকিছু ধ্বংস ও বিনষ্ট হয়ে যায় তার। সাংসারিক চাপ ও আর্থিক সংকট আরো বাড়তে থাকে। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী এনজিও থেকে বরাদ্দকৃত দো-চালা টিনের ঘরে বসবাস করতে থাকি। শারীরিকভাবেও স্বামী-স্ত্রী দুজনে অসুস্থ হয়ে পড়ে। সামাজিকভাবে কোন কর্মসংস্থানের উপায় ছিল না। তার ও তার স্বামীর দৃঢ় ইচ্ছা ছিল সন্তানদের যতদুর সম্ভব শিক্ষায় শিক্ষিত করা। এজন্য বিভিন্ন এনজিও, মহাজনের নিকট হতে চড়া সুদে ঋণ গ্রহণ করে সংসার, সন্তানদেরকে যথাসম্ভব পড়ালেখা চালানোর ক্ষেত্রে চেষ্টা অব্যাহত রাখে। সুদ সব বিশ থেকে পঁচিশ লক্ষ টাকা ঋণ কাঁধে নিয়ে চার সন্তানের পড়ালেখা সম্পন্ন করতে সক্ষম হই। বর্তমানে আমার সন্তানেরা স্নাকোত্তর সম্পন্ন করেছে এবং স্ব-স্ব ক্ষেত্রে সরকারী ও বেসরকারী দপ্তরে চাকুরী করছে। তিনি অনেক দুঃখ, কষ্ট সহ্য করে ছেলে মেয়েদের শিক্ষিত করেছেন। যার কারণে তিনি একজন সফল জননী নারী হিসেবে সমাজের মানুষের কাছে গ্রহণ যোগ্যতা অর্জন করেছেন। সে মনে করে আমার সন্তান সততা ও নিষ্ঠার সাথে দেশের দায়িত্ব পালন করবেন এবং সুনাগরিক হিসাবে নিজেকে তুলে ধরবেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাবেন। সে তার সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে নিজেকে একজন সফল জননী নারী মনে করেন।
নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন যে নারী তার নাম হোসনেয়ারা পারভীন। তিনি তার জীবন কাহিনীতে লিখেছেন- আমি হোসনেয়ারা পারভীন, পিতা-মো. অজিয়ার গাজী, মাতা-জাহানারা খাতুন, গ্রাম-বাইনতলা, ডাকঘর-পদ্মপুকুর, উপজেলা- শ্যামনগর, জেলা-সাতক্ষীরা। আমার প্রাপ্ত বয়সে আমার পিতা আমাকে বিবাহ দেন। আমি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ য়ে স্বামী সংসারে শান্তিপূর্ণভাবে সংসার করতে থাকি। আমার সংসার জীবনে আমি একটি পুত্র সন্তান ও একটি কন্যা সন্তানের জন্ম গ্রহণ করে। আমার সংসার চলাকালীন সময়ে এক পর্যায়ে আমার স্বামী আমার উপর অত্যান্ত নির্যাতন করতে থাকে। আমার স্বামী আমাকে বিভিন্ন সময় নির্যানত করা অবস্থায় ২০১৫ সালে অন্য একজন মহিলাকে বিবাহ করে আমাকে তালাক প্রদান করে। তালাক প্রদান করার পরে আমি ও আমার সন্তানেরা ব্যক্তিগত জীবনে আর্থিক ভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হই। আমাকে তালাক প্রদানের পর আমি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য এবং আমার সন্তারদের লেখাপড়া শিখিয়ে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে আমার পিতার সহযোগিতায় একটি চা ও পানের দোকান করি। বর্তমানে চা ও পানের দোকানে ব্যবসা করে আমি আমার জীবিকা নির্বাহ করি এবং ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাই। বর্তমানে আমার ছেলে অনার্স ৩য় বর্ষে লেখাপড়া করে এবং আমার মেয়ে একাদশ শ্রেণীর ২য় বর্ষে লেখাপড়া করে। আমার জীবনের অন্ধকার পথ পাড়ি দিয়ে আমি আলোর পথে আসছি। নারীদের কে আমি বলবো নির্যাতনের বিভীষিকা থেকে বেরিয়ে আসুন। জীবনটা এত সস্তা নয়। ‘ভেঙ্গে দাও নির্যাতনের কালো হাত, বজ্রকণ্ঠে করবো মোরা নির্যাতনের প্রতিবাদ।’ তাই আমি নিজেকে নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করা নারী মনে করি।
সমাজ উন্নয়নে অবদান রেখেছেন যে নারী তার নাম নীপা চক্রবর্তী। বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের বৈচিত্র্যময় সুন্দরবণের কোলঘেঁষে শ্যামনগর থানার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডে উত্তর কদমতলা গ্রামের গোপাল ব্যানার্জীর স্ত্রী নীপা চক্রবর্তী। তিনি তার জীবন কাহিনীতে উল্লেখ করেছেন-খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলার আমতলা গ্রামের মধ্যবিত্ত ব্রাক্ষ্মন পরিবারে জন্ম ১৯৮২ সালে। মায়ের গর্ভ থেকে প্রথম যে দিন এই পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হই তখন শুনি তিনবার জয়র ধ্বনি দিয়ে আমাকে বরণ করে নিল আমার পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু পাশের বাড়িতে পুত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ায় সাতবার জয়র ধ্বনি দিয়ে তাকে বরণ করে নিল। আমি সে দিনই বুঝেছিলাম কুসংস্কার প্রতিবন্ধকতার বেড়া জালে আবদ্ধ এই সমাজের সাথে অনেক সিমাবদ্ধতা অতিক্রময় করে আমাকে বেড়ে উঠতে হবে। তিন কন্যা সন্তানের অসহায় পিতা সমাজের পারিপার্শিক চাপে মাত্র ১৫ বছর বয়সে দশম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার সাথে সাথে আমাকে ১৯৯৭ সালে বিয়ে দিয়ে দেন আরও একটি মধ্যবিত্ত ব্রাক্ষ্মণ পরিবারে। শিকার হলাম বাল্যবিবাহের। একই বছরে গর্ভে সন্তান আসল। পরিবারের অসম্মতি হাজার প্রতিবন্ধকতাকে সাথে নিয়ে পড়ালেখাকে অব্যহত রাখলাম। ১৯৯৮সালে এসএসসি পাশের ফলাফল পাওয়ার কিছুদিন পরে পুত্র সন্তানের মা হলাম। কিন্তু বিভিন্ন মানুষিক নির্যাতনের শিকার অবস্থায় অপূর্ণ বয়সে মা হয়ে সন্তান হল অপুষ্টি জনিত। নিজের স্বাস্থ্যের ও অবনতি হল। তখনি মনে জিদ নিলাম আশে পাশে বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হবে। তখন সমাজে বাল্যবিবাহ, ডিভোর্স, বহুবিবাহ, মাতৃ মৃত্যু, মৃত সন্তান প্রসব, অপুষ্টজনিত সন্তান প্রসব, ঝাড় ফু, পানি পড়া, তাবিজ-কবজ, বিভিন্ন অন্ধত্বের শিকার গ্রামের অধিকাংশ মানুষ। ডায়রিয়া হলে স্যালাইন না খাওয়ায়ে খাওয়াত পুকুরের পানি পড়া। জ্বর হলে ডাক্তারের কাঝে না নিয়ে ঝাড় ফু করতো কোন কবিরাজ ডেকে। সিদ্ধান্ত নিলাম এই সকল সামাজিক ব্যাধি সমাজ থেকে দূর করতে হলে নারীদেরকে প্রচুর সচেতন করতে হবে। একজন সন্তানের জন্য সর্বত্তম শিক্ষক হলেন তার মা। কিন্তু তখন গ্রামের অধিকাংশ নারীরা ছিল অসচেতন। সামাজিক বৈষম্যতা, অসমতা হলো এর মূল কারণ। নারীদের ঘর থেকে বাহিরে আমার সুযোগ ছিল খুবি কম। তারা তাদের মত প্রকাশের ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সুযোগ পেত কম পরিবার থেকে সমাজে। এই জন্য তাদের উন্নয়নের জন্য জ্ঞান, দৃষ্টিভঙ্গি ও আচারণের পরিবর্তন দরকার। কিন্তু তার জন্য আমাকে আমার উন্নয়নের জন্য আগে ঘর থেকে বাহির হতে হবে। পরিবারের অসম্মতিতে এক প্রকার লড়াই করে ২০০০ সালে গণউন্নয়ন সংস্থা নামক একটি সংগঠনে স্বেচ্ছায় শ্রম দেয়ার মানসিকতা নিয়ে মাত্র ৫শত টাকা বেতনে স্বেচ্ছা সেবক হিসাবে যোগদান করি। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে নিজের জ্ঞান, দৃষ্টিভঙ্গি ও আচারণের পরিবর্তন করি। পরে উক্ত সংগঠনের কাজে বিভিন্ন এলাকায় যেয়ে অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের বঝাতাম বিয়ে নয়, বই নাও। উপকূলীয় নারীদের সংগঠিত করে সচেতন করতাম, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত, ইন্দ্রা গান্ধী, কবি সুফিয়া কামাল, মাদার তেরেসা, গণপ্রজান্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ যুগে যুগে যে সকল মহিয়ষী নারীরা সমাজে বিভিন্ন কর্মকান্ডের মধ্যে দিয়ে অবদান রেখে গেছেন বা অবদান রেখে যাচ্ছেন, প্রত্যের নারী এই সমাজের তারা ক্ষত বিক্ষত হয়ে লড়াকু জীবনে সফলতা অর্জন করেছেন। উপকূলীয় নারীদের জীবনের বাস্তবতা নিয়ে তাদেরকে কথা বলার সুযোগ করে দিতাম এবং তাদের মুখ থেকেই মন থেকেই কথা বলাতাম তাদের জীবনের মত মেয়েদের জীবণ যেন নষ্ট না করে অপূর্ণ বয়সে বিয়ে দিয়ে। বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের পাশাপাশি ‘মাদকতা কে না বলুন, পড়ালেখার পাশাপাশি খেলা ধুলাকে হ্যাঁ বলুন’ এই প্রতিপাদ্যকে সাথে নিয়ে তরুণদেরকে সংঘঠিত করে যুবশক্তি-শুভশক্তি কমিটির মাধ্যমে তাদের হাতে খেলা ধুলার জন্য ফুটবল তুলে দিতাম। পাশাপাশি পাশ্ববর্তী একটি কলেজ থেকে ২০০৯ সালে এইচএসসি পাশ করলাম। বিভিন্ন এনজিওতে চাকরির সুযোগ হতে লাগল আমার। শিখলাম চ্যালেঞ্জ বিহীন জীবন, লবণ বিহীন তরকারীরর মতো স্বাধহীন। এই বাস্তবতা থেকে আরো একটা বড় চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করলাম। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ইউপি সদস্য প্রার্থীতা ঘোষনা দিলাম অনেক সমালোচনাকে অতিক্রম করে পরিবারের অসম্মিতিতে ২০২১ সালে ২৬ ডিসেম্বর ইউপি নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে প্রথম বারেই জয়লাভ করি। আজ আমি সেই পরিবার ও সমাজের সাথে লড়াকু নারী ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত আসনের ইউপি সদস্য। সেই ১৯৯৮সাল থেকে ২০২৩ অদ্যাবধি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, যৌতুক প্রথা প্রতিরোধ, মাদক আসক্তি প্রতিরোধ, শিক্ষার ক্ষেত্রে মেয়েদের সচেতনতা কার্যক্রমে অগ্রণী ভুমিকা রাখা প্রভৃতি সামাজিক আন্দোলনে ভূমিকা পালন করা আমার নিত্যদিনের কর্ম হিসাবে অব্যাহত রেখেছি। এখন বাল্যবিবাহ, মাতৃ মৃত্যু, বহু বিবাহ, অপুষ্টিজনিত সন্তান প্রসব, ডিভোর্স, মাদকাসক্ত তরুণ সমাজের অবক্ষয় অনেক কমে এসেছে। নারী পুরুষের বৈশম্যতা কমে এসেছে। যতদিন না সমাজ থেকে এই অসংগতি দুর না হয় তার জন্য আমৃত্যু লড়ে যাব ও সমাজে লড়াকু নারী প্রতিষ্ঠা করে যাবো। সব মিলিয়ে প্রতিমা রানী মিস্ত্রী সমাজ উন্নয়নে অসাম্য অবদান রেখেছেন।
শ্যামনগর উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা শারিদ বিন শফিক জানান, এক সময়ের সমাজের অসহায় নারী যারা কঠোর পরিশ্রমে আজ নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। আমরা তাদের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়িত ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ শীর্ষক বিশেষ কর্মসূচীর আওতায় খুজে বের করে সম্মাননা প্রদান করেছি। এই সম্মাননা প্রদানের মাধ্যমে অনুপ্রেণিত হয়ে জীবন-জীবিকার মান উন্নত হয়ে তারা আরো এগিয়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন।