অনলাইন ডেস্ক ::
বিশ্ববাজারে হিমায়িত চিংড়ির চাহিদার কারণে প্রায় চার যুগ আগে বাংলাদেশী উদ্যোক্তারা পণ্যটি রপ্তানিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এ সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ কারখানা স্থাপন করা হয়। কিন্তু ২০০৮ সাল-পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে দাম কমে যায়। তখন থেকেই বিশ্ববাজারে ভেনামি চিংড়ির চাহিদা বাড়তে থাকে। অন্যদিকে দেশে উৎপাদিত বাগদা বা গলদা চিংড়ির চাহিদা কমতে শুরু করে। একটি জাতীয় দৈনিকের তথ্যমতে এক যুগ আগেও বছরে ৫০হাজার টন চিংড়ি বিশ্ববাজারে রপ্তানি হতো। কিন্তু সমাপ্ত অর্থবছরে তা নেমেছে প্রায় ২৪ হাজার টনে, যা অর্ধেকেরও কম। একই সময়ে হিমায়িত চিংড়ি থেকে রপ্তানি আয় ৫৭ কোটি থেকে কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৪ কোটি ডলারে। এদিকে বিশ্ববাজারে চিংড়ির চাহিদা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকায় সমাপ্ত অর্থবছরের শুরুতে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনা হয়। তবুও অর্থবছরের শেষে সেই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয়নি।
সংশিøষ্টরা বলছেন, মূলত ভেনামি চিংড়ির উৎপাদন ও বাজারজাত শুরু না করা, আবহাওয়া ও পরিবেশ অনুকুলে না থাকা এবং কাঁচামালের সংকটের কারণে বিশ্ববাজারে চিংড়ি রপ্তানি কমে যাচ্ছে। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ অনেক কারখানা।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএফইএ) ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) উদ্বৃতি দিয়ে জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রায় ৫০হাজার টন চিংড়ি রপ্তানি হয়েছিল। যার বাজারমূল্য ছিল আনুমানিক ৫৭ কোটি ডলার। অন্যদিকে ঠিক এক যুগের ব্যবধানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ২৪ হাজার টন, আর্থিক অংকে যা প্রায় ২৪ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক যুগের ব্যবধানে চিংড়ি রপ্তানি কমেছে প্রায় ২৭ হাজার টন বা ৫২ শতাংশ। আর্থিক অংকে যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৩ কোটি ডলার বা ৫৭ শতাংশ। বিগত এক যুগের হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ধারাবাহিকভাবে প্রতি বছরই কমেছে চিংড়ির রপ্তানি।
অন্যদিকে প্রকাশিত খবরে আরো বলা হয়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ৫০ কোটি ডলারের চিংড়ি রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু অর্থবছর শেষে মাত্র ৩০ কোটি ডলারের চিংড়ি রপ্তানি করা সম্ভব হয়। যে কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ২৯ কোটি ৭৯ লাখ ডলারের। বছর শেষে সেটা নেমে আসে মাত্র ২৪ কোটি ডলারে। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে চিংড়ি রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ৪০ শতাংশ কমিয়ে আনলেও সেই পরিমাণ অর্থের চিংড়ি রপ্তানি করা যায়নি।
যদিও সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অফিসের হিসাব মতে ২০২৩-২৪ মৌসুমে সাতক্ষীরার ছয়টি উপজেলায় ৫৯হাজার লবণ পানির ঘেরে বাগদা চিংড়ি চাষ হয়, যা থেকে ২৭ হাজার টন চিংড়ি উৎপাদন হয়। উৎপাদিত এসব বাগদা চিংড়ি থেকে রপ্তানি আয় হয় ২হাজার ২৫ কোটি টাকা। এ জেলায় মোট উৎপাদিত চিংড়ির ৯০ শতাংশ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয় এবং বাকি ১০শতাংশ দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে সরবরাহ হয়েছে। এর আগে ২০২২-২৩ মৌসুমে জেলায় ২৫ হাজার টন বাগদা চিংড়ি উৎপাদন হয়েছিল, যা থেকে রপ্তানি আয় হয় ১হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা। এ হিসাব অনুযায়ী চলতি মৌসুমে ১৫০ কোটি টাকা রপ্তানি আয় বেড়েছে। যদিও সাতক্ষীরা জেলায় বাগদা চিংড়ি উৎপাদনের এই হিসাব দেশের মোট রপ্তানীর হিসাবের তথ্যের সাথে ব্যাপক গরমিল লক্ষ্য করা যায়।
লক্ষ্যমাত্রার পরিসংখ্যান বিশেøষণ করলে দেখা যায়, বিগত পাঁচ বছরে সারাদেশে চিংড়ি রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল যথাক্রমে ৩৬ কোটি ১০ লাখ ডলার, ৪১ কোটি ৫০ লাখ, ৩৩ কোটি, ৫০ কোটি এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৯ কোটি ৭৯ লাখ ডলার।
গত এক যুগের মধ্যে শুধু ২০২১-২২ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি চিংড়ি রপ্তানি সম্ভব হয়েছে। এ সময়ে ৩৩ কোটি ডলারের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও ৪০ কোটি ৭২ লাখ ৫০ হাজার ডলারে ৩০ হাজার ৫৭১ টন চিংড়ি রপ্তানি হয়। মূলত কোভিড মহামারীকালে বিশ্ববাজারে চিংড়ির সরবরাহ কমে যাওয়ায় এবং মূল্যবৃদ্ধির কারণে তখন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি রপ্তানি সম্ভব হয়েছিল।
বিএফএফইএ সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আশরাফ হোসাইন সাংবাদিকদের বলেন, ‘হিমায়িত চিংড়ির রপ্তানি কমে যাওয়ায় আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। প্রতি বছর বিশ্ববাজারের চাহিদা বাড়লেও বাংলাদেশে ভেনামি জাতের চিংড়ি উৎপাদন না হওয়ায় আমরা বাজার হারিয়েছি। প্রক্রিয়াকরণ কারখানাগুলো কাঁচামালের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। শ্রমিকরা বেকার হয়ে গেছেন। ব্যাংকের সুদ দিতে না পেরে অনেকে কারখানাও বিক্রি করে দিয়েছেন।’
তথ্যমতে, দেশে চিংড়ি চাষের উপযোগী প্রায় আড়াই লাখ হেক্টর জমি রয়েছে। যার মধ্যে ২ লাখ হেক্টরে চাষ হয় বাগদা চিংড়ি। এছাড়া হিমায়িত মাছ রপ্তানি খাতে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১১০। এসব কারখানার বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা সাড়ে ৩ লাখ টন। মৎস্য অধিদপ্তরের আওতাধীন কক্সবাজার জেলার চকরিয়া-রামপুরা মৌজায় চিংড়ি চাষের উপযোগী সাত হাজার একর জমি অনাবাদি পড়ে রয়েছে। এ এলাকাটিকে চিংড়ি চাষের জোন হিসেবে ঘোষণা করা হলে এখান থেকে প্রক্রিয়াকরণ কারখানাগুলোর চাহিদার ৮০শতাংশ কাঁচামাল সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, চকরিয়া-রামপুরা এলাকায় যে চিংড়ি এলাকা আছে তাতে বড় পরিসরে চিংড়ি উৎপাদন সম্ভব। এ জমিকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার না করে শুধু চিংড়ি উৎপাদনে ব্যবহার করা হোক এবং রপ্তানিকারকদের অনুক‚লে দীর্ঘমেয়াদি লিজ প্রদান করে চিংড়ি চাষের সুযোগ চান তারা। এছাড়া যেসব ব্যবসায়ী পাইলট প্রকল্পের অধীনে রপ্তানির জন্য ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন করছেন, তাদের প্রণোদনা ও সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করে দেয়ার দাবি জানান তারা।
এ প্রসঙ্গে এমইউ সি ফুডস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শ্যামল দাস বলেন, ‘সারা বিশ্বে যেখানে চিংড়ি রপ্তানির প্রায় ৮০-৮২ শতাংশই হয় ভেনামি চিংড়ি, সেখানে আমরা ২০ শতাংশের বাগদা বা গলদা চিংড়ি নিয়ে কাজ করছি। প্রতি বছর এ রপ্তানি কমে আসছে। দেশের প্রথম ভেনামি চিংড়ি চাষের পাইলট প্রকল্পটি আমার হাত ধরেই শুরু হয়। হেক্টরপ্রতি যেখানে আমরা আট হাজার কেজি ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন করি, সেখানে বাগদার উৎপাদন হেক্টরপ্রতি ৬০০-৮০০ কেজি। বিশ্ববাজারে এ চিংড়ির চাহিদা বেশি।
ভেনামি চিংড়ি চাষের পরিকল্পনা করতে করতেই রপ্তানি খাতটি হাতছাড়া হয়ে গেছে উলেøখ করে তিনি বলেন, ‘বৃহৎ উদ্যোক্তারা এ চিংড়ি চাষে না এলে মাঠ পর্যায়ের চাষীদের দিয়ে বড় পরিসরে উৎপাদন সম্ভব নয়। তাছাড়া চিংড়ি উৎপাদনে কোনো বৃহৎ দিকনির্দেশনাও বিগত সরকারের পক্ষ থেকে আসেনি। আমরা চাই সরকার কৃষিপণ্যের মতো চিংড়ি চাষকে গুরুত্ব দিক। তাহলে এ খাতটির বড় সম্ভাবনা আছে।’
খাতসংশিøষ্টরা বলছেন, বিশ্ববাজারে এখন ৯৫ শতাংশই ভেনামি চিংড়ি। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া চিংড়ির মধ্যে ৯৫শতাংশই বাগদা চিংড়ি। ভেনামি জাতের চিংড়ি চাষে উৎপাদন খরচ ২৫-৩০ শতাংশ কম। তাই কম উৎপাদনশীল গলদা ও বাগদা চিংড়ি দিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন। এ অবস্থায় ভেনামি চিংড়ির রপ্তানি বৃদ্ধি করতে উদ্যোগ প্রয়োজন। এছাড়া বাগদা চিংড়ির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যকে বিবেচনায় নিয়ে এটিকেও নতুনভাবে ব্র্যান্ডিং করারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
##