ডেস্ক রিপোর্ট ::
ঢাকা থেকে খুলনা হয়ে সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালান বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এ রুট ব্যবহার করে স্বর্ণ পাচার করতে গিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে পাচারকারী আটকের ঘটনা বেড়েছে।
ঢাকা থেকে খুলনা হয়ে সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালান বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এ রুট ব্যবহার করে স্বর্ণ পাচার করতে গিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে পাচারকারী আটকের ঘটনা বেড়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ রুট ব্যবহার করে পাচারকৃত স্বর্ণের খুব অল্পই আটক করতে পারছেন তারা। বিভিন্ন সূত্রের তথ্যানুযায়ী, পাচারকৃত এ স্বর্ণ এখন ভারত থেকে অবৈধ পথে আনা বিভিন্ন পণ্যের বিনিময়ে ব্যবহার হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, শীতের মৌসুম হওয়ায় বাংলাদেশ থেকে ভারতে স্বর্ণ পাচার এখন বাড়ছে। ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবের মৌসুম হওয়ায় প্রতিবেশী দেশটিতে এ সময় মূল্যবান ধাতুটির চাহিদা বেড়ে যায়। মধ্যপ্রাচ্য বিশেষ করে দুবাই থেকে পাচার করে আনা এ স্বর্ণ ঢাকা থেকে সীমান্তবর্তী জেলা হয়ে পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। খুলনা বিভাগের কয়েকটি জেলা দিয়ে এ স্বর্ণ চোরাচালানের ঘটনা ঘটছে সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে যশোর, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গা দিয়ে স্বর্ণ পাচার করতে গিয়ে অনেকেই আটক হয়েছেন। বর্তমানে সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়েও স্বর্ণ পাচারের ঘটনা বাড়ছে। পুলিশ বলছে, এ চোরাচালান কার্যক্রমের সঙ্গে দেশের প্রভাবশালী অনেকেই জড়িত। এখন পর্যন্ত পাচার করার সময়ে স্বর্ণের বাহক অনেক ধরা পড়লেও চোরাচালান চক্রের মূল হোতারা বরাবরই আড়ালে থেকে গেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ভারত থেকে বৈধপথে খাদ্যশস্যসহ নানা পণ্য আমদানিতে প্রতিবন্ধকতা বেড়েছে। আবার বাংলাদেশে উচ্চমাত্রার খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে এর সুযোগ নিতেও সেখান থেকে অবৈধভাবে এসব খাদ্যপণ্যের চোরাচালান বেড়েছে। সীমান্তে এসব পণ্যের বিনিময়ে বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত স্বর্ণ প্রবেশ করছে ভারতে। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও সীমান্তে এভাবে পণ্য বিনিময়ভিত্তিক পাচার কার্যক্রমের তথ্য উঠে এসেছে।
গত ১৩ নভেম্বর রাত ১১টার দিকে ঢাকা-খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের সাঁচিবুনিয়া মোড়ে স্বর্ণ পাচারের অভিযোগে একজনকে আটক করে পুলিশ। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা সাতক্ষীরাগামী একটি বাসে তল্লাশি চালানোর সময় আবদুল আউয়াল নামের এক যুবকের আচরণে সন্দেহ হয় পুলিশের। শুরুতে থানায় নিয়ে তার দেহ তল্লাশির পর খুলনা নগরীর একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে এক্স-রে করানো হলে পেটে স্বর্ণের বারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। পরে তার পেট থেকে পরপর আটটি স্বর্ণের বার বের করা হয়।
এর আগে গত ৩০ অক্টোবর একই স্থান থেকে চার পিস স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়।
লবণচরা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইউসুফ আলী বলেন, ‘খুলনা অঞ্চলের সীমান্তপথ দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালানের মাত্রা দিনে দিনে বাড়ছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আনা স্বর্ণ ঢাকা থেকে খুলনা হয়ে সাতক্ষীরা ও যশোর অঞ্চলের সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার হচ্ছে। পাচারকারীরা এজন্য যাত্রীবাহী বাস বা পাবলিক পরিবহনে যাতায়াতকেই নিরাপদ ভাবছে সবচেয়ে বেশি। এসব পরিবহন ব্যবহার করে অভিনব নানা কৌশলে স্বর্ণ পাচার করা হচ্ছে।’
সর্বশেষ গত সোমবার ঢাকা-খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের ওই একই স্থানে দুজনকে আটক করা হয়। তবে এবার পাচারের জন্য স্বর্ণ আনা হয় চট্টগ্রাম থেকে। আটককৃতরা হলেন রাঙ্গামাটি জেলার রাজস্থলী উপজেলার মহব্বতপাড়ার বাবলু ধর ও চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলার আজাদী বাজার বণিকপাড়া এলাকার রতন মানিকের ছেলে নয়ন মানিক। ওইদিন সকালে চট্টগ্রাম থেকে সাতক্ষীরাগামী ইমাদ পরিবহনের একটি বাসে করে সাঁচিবুনিয়া বিশ্বরোড মোড়ে এসে নামেন আটককৃত দুই পাচারকারী। আচরণে সন্দেহ হলে টহল পুলিশের দল তাদের তল্লাশি চালায়। এক পর্যায়ে তারা পাচারের স্বর্ণ বহনের কথা স্বীকার করেন। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৫০ ভরির বেশি ওজনের কিছু গহনা উদ্ধার করা হয়। এগুলো ভারতে পাচারের জন্য চট্টগ্রাম থেকে সাতক্ষীরার উদ্দেশে নেয়া হচ্ছিল।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে পাচারের সময় শুধু খুলনার লবণচরা থানা এলাকায়ই নয়টি অভিযানে ৫৬টি স্বর্ণের বার, দুটি স্বর্ণের বেল্ট বকলেস ও একটি বালা উদ্ধার করা হয়। আটক করা হয় ১২ পাচারকারীকে। উদ্ধারকৃত প্রায় সাড়ে ৭ কেজি ওজনের স্বর্ণের দাম ৬ কোটি ১২ লাখ টাকার বেশি।
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. তৌহিদুজ্জামান জানালেন, ঢাকা-খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের লবণচরা থানা এলাকায় পরপর কয়েকটি চালান ধরা পড়ার পর এ রুট দিয়ে স্বর্ণ পাচার প্রতিরোধে পুলিশ আরো সক্রিয় অবস্থান নিয়েছে। একই সঙ্গে চোরাচালানে জড়িতদের খুঁজে বের করা এবং গ্রেফতারের প্রচেষ্টা চলছে।
তিনি বলেন, ‘স্বর্ণের চালানগুলো মূলত ঢাকা থেকেই বেশি আসে। এসব চালান ধরা পড়ায় চোরাকারবারে যাদের সংশ্লিষ্টতা ও নাম-ঠিকানা পাওয়া যায়, তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়। কিন্তু সমস্যা হলো পাচারের সময় তা বহুবার হাতবদল হয়। ফলে মূল হোতাকে শনাক্ত করা মুশকিল হয়ে পড়ে। তাদের নাম-পরিচয় জানতে পারাও বেশ কষ্টসাধ্য।’
বর্তমানে বৈশ্বিক স্বর্ণ আমদানি ও স্বর্ণ গহনা রফতানি—দুদিক থেকেই ভারতের অবস্থান শীর্ষে। দেশটিতে এখন প্রতিনিয়তই সম্প্রসারণ হচ্ছে স্বর্ণের কালোবাজার। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল (ডব্লিউজিসি) জানিয়েছে, এ মুহূর্তে
বিশ্বব্যাপী গৃহস্থালি পর্যায়ে স্বর্ণের সবচেয়ে বড় মজুদ রয়েছে ভারতে। দেশটির পরিবারগুলোর কাছে জমা স্বর্ণের পরিমাণ কমপক্ষে ২৫ হাজার টন। বিয়ে, ধর্মীয় উৎসব ও পারিবারিক নানা অনুষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য দেশটিতে স্বর্ণের চাহিদা প্রতিনিয়তই বেড়ে চলেছে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, ভারতে স্বর্ণ আমদানির ওপর উচ্চমাত্রায় শুল্ক আরোপ করা রয়েছে। এ কারণে প্রচুর চাহিদা থাকলেও দেশটিতে বৈধপথে স্বর্ণের আমদানি হয় কম। স্থানীয় চাহিদা পূরণে মূলত চোরাচালানের মাধ্যমে আমদানীকৃত স্বর্ণের ওপরই বেশি নির্ভরশীল দেশটির গহনা ব্যবসায়ীরা।
ক্রমবর্ধমান এ চাহিদার কারণে ভারত এখন বৈশ্বিক স্বর্ণ চোরাচালানের সবচেয়ে বড় গন্তব্য দেশ হয়ে উঠেছে। আর দেশটিতে পাচারকৃত স্বর্ণের বড় উৎস এখন বাংলাদেশ।
ভারতীয় শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থা ডিরেক্টরেট রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্সের তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে পরিচালিত এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ পাচার হয় শীতের তিন মাস অক্টোবর-ডিসেম্বরে। মূল্যবান ধাতুটির আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতে স্বর্ণ পাচারের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এমন পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন বেঙ্গালুরুভিত্তিক সেন্ট জোসেফস ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট এবং পন্ডিচেরি ইউনিভার্সিটির তিন গবেষক। ‘গোল্ড স্মাগলিং ইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইটস ইফেক্ট অন দ্য বুলিয়ন ইন্ডাস্ট্রি’ শীর্ষক গত মার্চে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসা এ পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত পোষণ করছেন দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরাও।
তাদের ভাষ্যমতে, শীতকালে কুয়াশা বেশি থাকার কারণেও চোরাকারবারিরা এর সুবিধা নিতে বেশি তৎপর হয়ে ওঠে। আবার এ কুয়াশার কারণেই শীতে পাচারের সময় স্বর্ণ জব্দের পরিমাণও কমে যায়। বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২৩ পর্যন্ত চার বছরে সীমান্ত এলাকায় পাচারের সময় মোট প্রায় ৫৯৪ কেজি স্বর্ণ জব্দ করেছেন বাহিনীটির সদস্যরা। এর প্রায় ৪৪ শতাংশই আটক হয়েছে গত বছর। ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসে দেশের সীমান্ত এলাকা থেকে পাচারের সময় জব্দ করা হয়েছে ২৬০ কেজি ৫৬৭ গ্রাম স্বর্ণ। এর মধ্যে অক্টোবরে ১৪ কেজি ৭৯৪ গ্রাম, নভেম্বরে ২৭ কেজি ৪০০ ও ডিসেম্বরে ১১ কেজি ৬৪৩ গ্রাম স্বর্ণ আটক করা হয়।