অনলাইন ডেস্ক ::
সুন্দরবনের শিবসা নদীর পশ্চিমের খাল পাটাকাটা। পাশের মাঝারি আর ছোট খাল দিয়ে ঘেরা জঙ্গলে প্রচুর হরিণ আছে। ওই এলাকায় শিকারিদের চলাচলও বেশি থাকে। তবে রজব আলীরা সেখানে গিয়েছিলেন মাছ ধরতে। দুটি নৌকায় তাঁরা দুই ভাইসহ ছিলেন চারজন। হঠাৎ দেখেন, অস্ত্র হাতে পাঁচটি নৌকায় বনদস্যুরা তাঁদের দিকে এগিয়ে আসছেন। এই অবস্থায় দ্রুত পালানোর জন্য নৌকা বেয়ে খালের মধ্যে এগোতে থাকেন। একেবারে খালের শেষপ্রান্তে গিয়ে থামেন।
রজব আলী বলেন, ‘দস্যু দলের নৌকার বহর আমাদের বেশ পেছনে ছিল। আমরা তাদের আর না দেখতে পেয়ে ভেবেছিলাম, এখন হয়তো নিরাপদ। কিন্তু কিছুক্ষণ পর হঠাৎ দেখি জঙ্গলের ভেতর থেকে ১৮ জনের এক দস্যু দল আমাদের ঘিরে রেখেছে। আসলে ওরা নৌকা রেখে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আড়াআড়ি হেঁটে আমাদের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। ধরা পড়ে যাই আমরা।’
সুন্দরবন–সংলগ্ন খুলনার কয়রা উপজেলার ৬ নম্বর কয়রা গ্রামের বনজীবী জেলে রজব আলী। গত ৬ জানুয়ারি বনদস্যুদের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে ফিরে আসার পর কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তাঁদের অপহরণ করেছিল দস্যু দল রবিউল বাহিনী। ডাকাত সরদার রবিউলকে এর আগেও তিনি দেখেছেন। কয়রা উপজেলায় বাড়ি তাঁর।
রজব আলীদের জেলে দলটিকে টানা দুই দিন দস্যুরা জিম্মি করে রাখে। এরপর একটি নৌকা আর রজব আলীর ছোট ভাই রিয়াজুল ইসলামকে রেখে বাকিদের ছেড়ে দেয় ডাকাতেরা। ছাড়ার সময় বলে দেয়, দেড় লাখ টাকা নিলে ছোট ভাই আর নৌকা ফেরত দেবে।
রজব আলী বলেন, ‘ছোট ভাইটা এখনো বনদস্যুদের হাতে। যেকোনো সময় মুক্তিপণের টাকা চেয়ে ফোন দিতে পারে ডাকাতেরা। এ জন্য মুঠোফোনটিও সব সময় কাছে কাছে রাখি। তবে দেড় লাখ টাকা তো দেওয়ার সামর্থ্য নেই আমাদের। ফোন দিলে কথা বলে দেখব কত টাকা কমানো যায়। ভাইটাকে ছাড়াতে পারলে আর কোনো দিন জঙ্গলে যাব না।’
১০ জানুয়ারি কয়রার সুন্দরবন–সংলগ্ন এলাকায় ঘুরে বনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে ডাকাত-আতঙ্কের কথা জানা গেছে। বনদস্যুরা গত এক মাসে অর্ধশতাধিক জেলেকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছে। এ সময় টাকা আদায়ের জন্য তারা জিম্মি ব্যক্তিদের ওপর নির্যাতনও চালিয়েছে। এ কারণে অনেক জেলে এখন বনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পেশা বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। কেউ ভ্যান চালিয়ে, কেউ দিনমজুরি করে সংসার চালাচ্ছেন।
জেলেরা জানান, আত্মসমর্পণকারী অনেক বাহিনী আবার দস্যুতায় ফিরেছে। বিশেষ করে পশ্চিম সুন্দরবনে মজনু বাহিনী, শরীফ বাহিনী, দয়াল বাহিনী, রবিউল বাহিনী, আবদুল্লাহ বাহিনী, মঞ্জুর বাহিনী, মাসুম বিল্লাহ ভাগনে বাহিনীর তৎপরতা বেড়েছে। তাদের সদস্যরা বাটলু, আন্ধারমানিক, আড়পাঙ্গাসিয়া, ঝাঁলে, পাটকোস্টা, ভ্রমরখালী, আড়ুয়া শিবসা, দুধমুখ, মান্ধারবাড়ি, আলকি, জাবা ও হংসরাজ খাল ও নদীতে অহরহ দস্যুতা সংঘটিত করছে।
গত এক মাসের মধ্যে বনদস্যুর মুক্তিপণ দিয়ে জিম্মিদশা থেকে ফিরে এসেছেন কয়রার বেশ কয়েকজন জেলে। তাঁদের মধ্যে ছলেমান মোল্লা, নজরুল গাজী, সুশান্ত রপ্তান, ইমামুদ্দীনসহ অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জিম্মিদশা থেকে মুক্তির জন্য তাঁদের সর্বনিম্ন ২০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত দস্যুদের দিতে হয়েছে। প্রতিটি দস্যু বাহিনীতে ১০-১২ জন সদস্য রয়েছে। তাঁদের সবাই আগ্নেয়াস্ত্রধারী।
বনজীবীদের অভিযোগ, দস্যুদের পেছনে ইন্ধন দিচ্ছেন কিছু অসাধু মাছ ও কাঁকড়া ব্যবসায়ী। তাঁরা সুন্দরবনের প্রবেশ নিষিদ্ধ এলাকার খাল নিয়ন্ত্রণে রাখতে ডাকাতদের বনে নামাচ্ছেন। ডাকাতেরা সাধারণ জেলেদের জিম্মি করলেও ব্যবসায়ী–মহাজনদের অধীনস্থ জেলেদের কিছুই বলে না। এমন পরিস্থিতিতে শত শত জেলে সুন্দরবনে যেতে পারছেন না। এতে তাঁদের পরিবারে অভাব-অনটন দেখা দিয়েছে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ থেকে কয়েক ধাপে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সুন্দরবনের ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন দস্যু ৪৬২টি অস্ত্র ও ২২ হাজার ৫০৪ গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করেছিলেন। পরে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সুন্দরবনকে ‘দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা করা হয়।
এ বিষয়ে খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, ‘সুন্দরবনে জেলেদের অপহরণের ঘটনার খবর আমরাও পাচ্ছি। কয়েক দিন আগে সুন্দরবনের তক্কাখালী এলাকায় বনদস্যুদের সঙ্গে আমাদের গোলাগুলিও হয়েছে। আগের মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে অভিযান চালালে অতি দ্রুত বনদস্যুদের তৎপরতা বন্ধ করা সম্ভব হবে।’