গোলাম সরোয়ার ::
সাতক্ষীরার দুটি পৌরসভাসহ জেলার সাতটি উপজেলাতেই কমপক্ষে ২২ লাখ মানুষ তীব্র খাওয়ার পানি সংকটে রয়েছে। জীবনধারন করতে আর্সেনিক, আয়রণ ও লবণযুক্ত পানি করছেন এসব মানুষজন। এছাড়া উচ্চ বা মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষজন কোম্পানীর বোতলজাত পানির প্রতি নির্ভর হয়ে পড়ছে। এতে তাদের ব্যয়ও বাড়ছে পানি সংগ্রহে।
তবে সবচেয়ে বেশি সুপেয় পানির সংকটের রয়েছে জেলার উপকূলীয় চারটি উপজেলার মানুষ। এসব উপজেলাগুলো হচ্ছে শ্যামনগর, আশাশুনি, কালিগঞ্জ ও দেবহাটা।
অন্যদিকে স্বাস্থ্য বা মেডিসিন বিষেশজ্ঞদের অভিমত নিয়মিত আর্সেনিক, আয়রণ ও লবণযুক্ত পানি করলে মানুষের লিভার ও কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুকি রয়েছে।
উপকুলীয় শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের ধুমঘাট গ্রামের গৃহবধু অঞ্জলি রানী (৩৫) ও মিনতি রানী (৩২) বলেন, তাদের গ্রামসহ আশাপাশের গ্রামের মানুষজনের মধ্যে সুপেয় পানির সংকট তীব্র। এলাকায় বসবাসরত মানুষজন এতই গরিব বা দরিদ্র যে, টাকা দিয়ে নিরাপদ পানি কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই তাদের। তাই জীবনধারন করতে গ্রামের অধিকাংশ নারী অনেক পথ পাড়ি দিয়ে পানি সংগ্রহ করেন। এতে তাদের সাংসারিক কাজ ব্যাহত বলে জানান গৃহবধু অঞ্জলি রানী মন্ডল ও মিনতি রানী মন্ডল । তারা আরো জানান, শুধু ধুমঘাট নয় পাশ্ববর্তী জেলেখালী, মুন্সিগঞ্জ, যতিন্দ্রনগর, ভইরবনগর, আড়পাংশি ও হরিনগরসহ বহু গ্রামের মানুষ সুপেয় পানির কষ্টে রয়েছে।
সুপেয় পানি সংকটের একই অবস্থা তুলে ধরে আশাশুনি উপজেলার আনুলিয়া (একশোরা) গ্রামের কৃষি শ্রমিক মোমিন আলী ও আবু তালেব বলেন, জীবনধারন করতে তারা লবণ পানি পান করেন। তবে বর্ষা মৌসুমে এলাকার পুকুর বা অন্যান্য জলাশয় থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে পারেন। তবে শুষ্ক মৌসুমে তীব্র সংকটে পড়েন খাওয়ার পানি সংকটে। তারা আরো বলেন, গ্রামের সব টিউবয়েলের পানিতে পর্যাপ্ত লবণ।
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র মেডিসিন বিষেশজ্ঞ ডাক্তার মানস কুমার মন্ডল জানান আর্সেনিক, আয়রণ ও লবণযুক্ত পানি নিয়মিত পান করা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এরমধ্যে আর্সেনিকযুক্ত পানি একাধারে পান করলে লিভার ও কিডনি আক্রান্তের পাশাপাশি মরনব্যধি ক্যান্সারও হতে পারে। এছাড়া আয়রণযুক্ত এবং লবণাক্ত পানি পান করলে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোর্গের পাশাপাশি পেটের পিড়া দেখা দিতে পারে। তিনি বলেন, সুস্থ্য থাকলে হতে পানি বিশুদ্ধ করা বা ফুটিয়ে পান করার কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় পানি কমিটির সভাপতি এবি.এম শফিুকুল ইসলাম জানান, দেশের দক্ষিন-পশ্চিঞ্চালের মধ্যে উপকূলীয় সাতক্ষীরা জেলাতে কমপক্ষে ২২ লাখ মানুষ সুপেয় পানির সংকটে আছে। তিনি বলেন, এখানে শতভাগ নলকুপ বা টিউবয়েলের পানিতে আছে আয়রণ, আর্সেনিক এবং লবণ। এরমধ্যে সাতক্ষীরা সদর, কলারোয়া ও তালা উপজেলার নলকুপ বা টিউবয়েলের পানিতে রয়েছে আর্সেনিক ও আয়রণ। এছাড়া শ্যামনগর, আশাশুনি, কালিগঞ্জ ও দেবহাটা উপজেলার সকল নলকুপ বা টিউবয়েলের পানিতে রয়েছে পর্যাপ্ত লবণ। যা মানুষের খাওয়ার উপযোগি নয়। তিনি বলেন, এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় পানি কমিটির পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় সরকারের কাছে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এসব সুপারিশের মধ্যে রয়েছে সরকারী ভাবে পর্যাপ্ত পানি শোধনাগার স্থাপন করা, পুকুর খননের মাধ্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষনের ব্যবস্থা করা এবং গভীর নলকূপ স্থাপন করা। এছাড়া ভূগর্ভের পানি অপচয় রোধ করার সুপারিশও করা হয়। তিনি বলেন, একজন কৃষকের বোরো চাষের জন্য যে পরিমান পানির চাহিদা থাকে তার তিনগুন পানি উত্তোলন করা হয় ভূগর্ভস্থ থেকে। ফলে পানির স্তর দিনকে দিন নিচে চলে যাচ্ছে। কিন্ত কেন্দ্রীয় পানি কমিটির এসব সুপারিশগুলো উত্থাপন করার পরও সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব এ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ জানান, দুটি পৌরসভাসহ জেলার সকল উপজেলাতেই খাওয়ার পানির সংকট। উপকূলীয় উপজেলাগুলোতে রয়েছে পানিতে অতিমাত্রায় লবণ এবং সদর, কলারোয়া ও তালার টিউবয়েলগুলোতে পর্যাপ্ত আর্সেনিক ও আয়রণ। ফলে মানুষের বোতলজাত পানি ক্রয় ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকছেনা। তবে বিপাকে পড়েছেন নিম্মআয়ের মানুষজন। তারা সংসার নির্বাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে পানি কিনে খাবে কি ভাবে? ফলে বাধ্য হয়ে তারা লবণ বা আর্সেনিক ও আয়রণযুক্ত পানি পান করছেন। তিনি সুপেয় পানি সংকট মেটাতে জেলায় বেশি বেশি পুকুর খননের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি সংরক্ষন করার আহবান সরকারের প্রতি।
এব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে সাতক্ষীরা জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী ইব্রাহিম তৈমুর জানান, দুই তিনদিন আগে সাতক্ষীরায় যোগদান করেছেন। এ জেলা সম্পর্কে তিনি এখনো অবগত নন। পরবর্তীতে খোঁজখবর নিয়ে জানাবেন।
#