ডেস্ক রিপোর্ট ::
নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ খ্যাত সুন্দরবন। সেই জনমানবশূন্য গহীন বনে গাছগাছালির ভেতর ইট-পাথরের তৈরি সুউচ্চ টাওয়ার। যেখানে দাঁড়িয়ে দেখা যায় বিস্তীর্ণ এক সবুজের সমারোহ। রয়েছে ৩৫০ বছরের আগের মন্দির। অদ্ভুত নৈসর্গিক সৌন্দর্যের সমন্বয়ের নাম শেকেরটেক।
ঈদের তৃতীয় দিন খুলনার সুন্দরবন ঘেঁষা কয়রা উপজেলা বন বিভাগ থেকে পর্যটকদের ভ্রমণের অনুমতিপত্র দেওয়া হয়েছে। ৫২ জনের ভ্রমণকারী দলের সঙ্গী হয়েছিলেন ঢাকা মেইলের প্রতিবেদক। সুন্দরবনে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আধার শেকেরটেক দেখার ভিন্ন রকম অভিজ্ঞতাই এখানে তুলে ধরা হয়েছে।
খুলনার দক্ষিণের উপকূলীয় জনপদ কয়রা অনেকটা সুন্দরবন বেষ্টিত। কয়রা সদর পিচঢালা পথ বেয়ে ৭-৮ কি. মি. দূরে সুন্দরবন সংলগ্ন কাটকাটা। সেখান থেকে ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে চেপে আমাদের ৫২ জনের টিমের গন্তব্য শেকেরটেক ইকো-ট্যুরিজম। শাকবাড়িয়া দিয়ে ট্রলারে একপাশে লোকালয়, অন্যপাশে সুন্দরবন। মিনিট ত্রিশেক পর আমাদের ট্রলার ঢোকে খড়খড়িয়া খালে। এবার দু’পাশে ঘন জঙ্গল। কখনও কেওড়া গাছের সারি, কখনও গেওয়া, গরান ও বাইনের সমারোহ। মনোমুগ্ধকর এক অনুভূতি।
আরও ঘণ্টাখানেক ট্রলার চলতেই বজবুজিয়া ফাঁড়ি সংলগ্ন ত্রিমোহনা। তখনও ট্রলার চলছে তার গন্তব্যে। গহিন জঙ্গলের ভেতর ঝপঝোপিয়া ও আড়ুয়া শিবসা নদী দিয়ে এঁকেবেঁকে ট্রলার চলে যায় গহিন বনের শিবসা নদীতে। শান্ত শিবসার বুক চিরে ট্রলার চলছে। ট্রলারে বসে একটু খেয়াল করলে বনের ভেতরটা দেখা যায়। কেওড়া বনের নিচে ঝোপ-জঙ্গল কম। বনের ভেতরে তাকিয়ে দেখা গেল, হরিণ ও বন্য শূকরের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে। বানরের পাল দৌড়ঝাঁপ করছে। ‘খাল বা নদীর ধারে দল বেঁধে হরিণের চলাফেরার দৃশ্য এখন হরহামেশাই চোখে পড়ে।’
গন্তব্য সদ্য সংস্কার করা গহিন বনের শেকেরটেক ইকোট্যুরিজম। সাধারণত ইকো-ট্যুরিজম বলতে সেখানে দেখভালের জন্য লোকজন এবং খাবার দোকানসহ শিশুদের জন্য নানান আয়োজন থাকবে। কিন্তু এ এক ভিন্ন রকমের বিনোদনের স্থান। এখানে সেসবের কোনো আয়োজন নেই। এটা জনমানবশূন্য এক স্থান। আশেপাশে পশু-পাখি, বাতাসের শো শো শব্দ, গাছের মড় মড় আওয়াজ ছাড়া রয়েছে নিস্তব্ধ নীরবতা।
শেকেরটেক পৌঁছানোর আগে শিবসা পাড়ি দিতেই চোখে পড়বে গাবগাছের বাগান। ম্যানগ্রোভ এই বনে সুন্দরী, গেওয়া, গরানসহ শত শত প্রজাতির গাছ সচরাচর দেখা গেলেও গহিন বনে গাবগাছের বাগান দেখাটা বিস্ময়ের। মিনিট বিশেক ট্রলার চলার পর পৌঁছে যাই গন্তব্য। পর্যটকদের সুবিধার্থে খালের সঙ্গে পল্টুনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আমাদের ট্রলার নোঙর করলো সেখানে।
শেখেরটেক খাল থেকে মন্দিরের চারপাশ দিয়ে পাকা পথ তৈরি করা হয়েছে। পর্যটকদের সুন্দরবন দেখার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে সুউচ্চ ওয়াচ টাওয়ার। আর চারপাশে গাছগাছালির ভেতর দিয়ে এক থেকে দেড় কিলোমিটারের দীর্ঘ পাকা পথ ধরে বনের মধ্যে অনায়াসে হেঁটে হেঁটে দেখা যায় সুন্দরবনের সৌন্দর্য। বনে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে বসার জন্য তৈরি করা হয়েছে বিশ্রাম ঘর। আর শেখেরটেক মন্দিরে যাওয়ার পথেই দেখা মেলে মধ্যযুগীয় স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ। চোখে পড়ে কোনো রকমে টিকে থাকা বাড়ির দেয়াল ও ইটের স্তূপ। কংক্রিটের সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় দু’পাশে চোখে পড়ে গেওয়া, গরান, বাইনসহ হরেক রকমের গাছে ফুটে থাকা ফুল।
সম্প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কার করা হয়েছে স্থানটি। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আগে এখানে নিয়মিতই বাঘের দেখা মিলতো। কংক্রিটের কাজ করা শ্রমিকরা জানিয়েছেন ভয় নিয়েই কাজ করতেন তারা। চোখের সামনেই দেখেছেন বাঘ। বাঘের যাতায়াত থাকায় জায়গাটি বাঘের বাড়ি নামেও পরিচিত।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম এ আজিজ তার ‘সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ইতিহাস’ বইয়ে লিখেছেন, শিবসা নদী-সংলগ্ন যে ধ্বংসাবশেষ বর্তমানে দেখা যায়, সেগুলো কমপক্ষে ৪০০ বছর আগে স্থাপিত হয়ে থাকতে পারে।’
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, শিবসা নদীর পাড়ের গাবগাছের বাগান ও প্রাচীন স্থাপনার ধ্বংসাবশেষটি বারো ভূঁইয়া বা মোগলদের সমসাময়িক সময়কালের বলে মনে করা হয়। ওই এলাকাটি বনের অন্যান্য স্থানের তুলনায় কিছুটা উঁচু হওয়ায় বাঘের আধিক্য বেশি। কয়েক বছর আগেও গাবগাছের বাগান ঘিরে বড় ইটের তৈরি সীমানাপ্রাচীর ছিল। নদীর ভাঙনে হারিয়ে গেছে সেটি। তবে নদীভাঙনের বিষয়টি প্রাকৃতিক।