ডেস্ক রিপোর্ট ::
সাতক্ষীরা জেলায় গত ৬ মাসে কমপক্ষে ২৪টি আত্মহননের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ১১জন বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। তাদের বয়স ১৫ থেকে ২০ বছর। এছাড়া ষাটোর্দ্ধ ব্যক্তি রয়েছেন অন্তত ৩জন। গেল জুন মাসেই জেলায় অন্তত ১১টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। এর আগে মে মাসে জেলায় কমপক্ষে ৫টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। এপ্রিল মাসে আত্মহত্যা করেন ৩জন। মার্চ মাসে একজন, ফেব্রæয়ারি মাসে ৩জন এবং জানুয়ারি মাসে একজন আত্মহত্যা করেন। এ নিয়ে জেলায় গত ৬মাসে অন্তত ২৪জনের আত্মহত্যার খবর পাওয়া গেছে। আত্মহননকারীদের অধিকাংশই স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। এছাড়া পারিবারিক অশান্তির কারণেও স্বেচ্ছামৃত্যুবরণ করেছেন অনেকেই। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এতে সচেতন মহল উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, পহেলা জুন সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে শ্বশুর বাড়ি থেকে বাবার বাড়ি বেড়াতে এসে আত্মহত্যা করেন কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের কালিকাপুর মধ্যপাড়ার আব্দুল মালেকের মেয়ে ও পার্শ্ববর্তী রামনগর গ্রামের মনিরুজ্জামানের স্ত্রী পারভীন সুলতানা (৩৪)। একই দিন আত্মহত্যা করেন আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের দক্ষিণ খাজরা গ্রামের বেলাল হোসেনের কন্যা জরিনা খাতুন (১৫)।
১০ জুন শ্যামনগরে খাজুরী সুলতানা জুই (১৭) নামে এক ছাত্রী আত্মহত্যা করেন। উপজেলা তারানীপুর গ্রামে তার নানার বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। ওই ছাত্রী জয়াখালী গ্রামে আব্দুল কাদের গাজীর কন্যা ও স্থানীয় ভেটখালী এ.করিম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির ছাত্রী। একই দিন সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে মৌসুমী পারভীন (১৭) নামে এক আত্মহত্যা করেন। উপজেলার মৌতলা ইউনিয়নের পাানিয়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। নিহত মৌসুমী পারভীন পানিয়া গ্রামের নূর ইসলামের মেয়ে। তিনি চলতি বছর এসএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
১৫জুন তালায় প্রেমিকের উপর অভিমান করে প্রিয়াঙ্কা সরকার (১৯) নামক এক কলেজ ছাত্রী চিরকুট লিখে আত্মহত্যা করেন। তিনি তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের হাতবাস গ্রামের মিঠুন সরকারের মেয়ে। এঘটনায় তালা থানায় একটি মামলা রুজু করা হয়। ২০ জুন কলারোয়ায় আত্মহত্যা করেন কেঁড়াগাছি গ্রামের মোটরসাইকেল চালক আলমগীর হোসেনের কন্যা রিয়া আক্তার (১৭)। ২১ জুন দেবহাটা উপজেলার কুলিয়ায় অন্য পুরুষের সাথে স্ত্রীকে ঘুরতে দেখে আত্মহত্যা করেন কুলিয়া ইউনিয়নের বহেরা গ্রামের আব্দুল মজিদ গাজীর ছেলে আব্দুস সালাম (৩০)। তিনি পেশায় এক দিনমজুর ছিলেন। ২৪ জুন অমৃতা ঘোষ (১৫) নামে এক স্কুল ছাত্রী আত্মহত্যা করেন। অমৃতা ঘোষ জেলার পাটকেলঘাটা থানার মির্জাপুর এলাকার কার্তিক ঘোষের মেয়ে ও মির্জাপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী। ২৬জুন শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার চকবারা গ্রামের আকছেদ আলী গাজীর ছেলে মনিরুল ইসলাম বাবু (২৫) আত্মহত্যা করেন। ২৯ জুন শ্যামনগরের গাবুরায় ৯নং সোরা গ্রামের মুনছুর মালির ছেলে হাসান মালী (৩০) নামের যুবকের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশের ধারণা হাসান মালী (৩০) আত্মহত্যা করেছেন।
৩০ জুন সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে বৃষ্টি মন্ডল (১৪) নামে ৮ম শ্রেণির এক ছাত্রী বিষপানের ২৫দিন পর মারা যায়। সে উপজেলার মৌতলা ইউনিয়নের ল²ীনাথপুর গ্রামের বিশ^জিৎ মন্ডলের মেয়ে। বৃষ্টি মন্ডল দক্ষিণ শ্রীপুর কুশলিয়া উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্রী ছিল।
মে মাসে সাতক্ষীরায় অন্তত ৫টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। সূত্র জানায়, ৩ মে আশাশুনি উপজেলা বুধহাটা ইউনিয়নে এক বৃদ্ধ আত্মহত্যা করেন নুরু শেখ (৬৫) নামে জনৈক ব্যক্তি। ৫ মে কলারোয়ায় কৃষক আমিরুল করিম (৭৪) নামের এক কৃষকের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ১৪ মে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে শিউলী বসাক (৩০) নামে এক গৃহবধূ আত্মহত্যা করেন। তিনি উপজেলার কুশলিয়া ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের বিজন মন্ডলের স্ত্রী। ১৬ মে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে মিজানুর রহমান (৬২) নামে এক শ্রমিক আত্মহত্যা করেন। উপজেলার চাম্পাফুল ইউনিয়নের দক্ষিণ বালাপোতা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। আত্মহননকারী মিজানুর রহমান বালাপোতা গ্রামের মরহুম বাবুল উদ্দীনের ছেলে। ২৯ মে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে সোহাগি আক্তার ওরফে হেনা (২০) নামে এক যুবতী আত্মহত্যা করেন। তিনি উপজেলার মথুরেশপুর ইউনিয়নের শীতলপুর গ্রামের হান্নান সরদারের মেয়ে।
এপ্রিল মাসে সাতক্ষীরায় ৩জনের আত্মহত্যার খবর পাওয়া যায়। সূত্রমতে, ১৪এপ্রিল সাতক্ষীরা শহরের কামালনগর এলাকার ইরানি আফরোজ তানু (২৭) নামের এক গৃহবধূ আত্মহত্যা করেন। ১৭এপ্রিল শ্যামনগরে প্রেমিকার উপর অভিমান করে প্রদীপ কুমার মন্ডল (২৭) নামের এক যুবক আত্মহত্যা করেন। ২৪এপ্রিল রাতে তালা উপজেলার খলিষখালী ইউনিয়নের বিশ্বেষকাটি গ্রামের সুকুমার মন্ডলের স্কুল পড়ুয়া কন্যা লাবনী মন্ডল (১৬) বিষপানে আত্মহত্যা করেন।
মার্চ মাসে একজনের আত্মহত্যার খবর পাওয়া যায়। ১৮মার্চ সাতক্ষীরা শহরতলীর ঝুটিতলায় আত্মহত্যার চেষ্টাকারী স্ত্রী রুপা খাতুনকে বাঁচিয়ে স্বামী সোহেল রানা (২৫) আত্মহত্যা করেন।
চলতি ২০২৪ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে সাতক্ষীরায় ৩জন আত্মহত্যা করেন বলে খবর পাওয়া যায়। পহেলা ফেব্রæয়ারি দেবহাটায় দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী হেমা পারভীন (১৫) আত্মহত্যা করেন। ৪ফেব্রæয়ারি সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে আবুল হাসান (২৮) নামের এক যুবক আত্মহত্যা করে। ৬ফেব্রæয়ারি সাতক্ষীরার তালায় নদী বিশ্বাস (১৪) নামের নবম শ্রেণীর এক ছাত্রী আত্মহত্যা করে। জানুয়ারি মাসে একজনের আত্মহত্যার খবর প্রকাশ হয়। ২৬ জানুয়ারি সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে আল আমিন সরদার (২০) নামের এক কলেজ ছাত্র আত্মহত্যা করে।
সাতক্ষীরার বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও ‘নিজ অধিকার’ একটি উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ড. দিলীপ কুমার দেবের ভাষ্যমতে, আত্মহত্যা প্রতিরোধে আশাহীন মানুষের মধ্যে আশা জোগাতে হবে। আত্মহত্যা প্রতিরোধযোগ্য। মানসিক রোগ সম্বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি ও আগে থেকেই এগুলো চিহ্নিত করে চিকিৎসা দিলে আত্মহত্যা প্রতিরোধে সহায়ক হবে।
তিনি বলেন, আত্মহত্যার অন্যতম ঝুঁকি হচ্ছে-মেজর ডিপ্রেশন, মদ ও মাদকাসক্তি, সিজোফ্রেনিয়া ও পূর্বে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে তেমন ব্যক্তিরা। অথচ আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে তেমন ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমরা টিটকারি করি, অবহেলা বা অবজ্ঞা করি। বলি তারা ‘ঢং’ করছে, মনোযোগ পেতে চাচ্ছে, সুবিধা আদায় করতে চাচ্ছে। প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে তারা আবেগীয় ও মানসিকভাবে অতি দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী। একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে, পরবর্তী সময় আত্মহত্যা করার হার তাদের ছয় গুণ বেশি। তারা সামান্য কারণে ভেঙে পড়ে, হতাশ হয়, ক্ষুব্ধ হয় ও গøানিতে ভুগে। পরিবার ও স্কুলে তেমন ঝুঁকিপূর্ণ ছেলেমেয়েদের চিহ্নিত করতে হবে এবং তাদের আচরণ যত বিরক্তিকর, অসহ্য মনে হোক না কেন-ঘৃণা, অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য করে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করা ঠিক হবে না। বরং তাদের দরকার যতœ, স্নেহ, সহায়তা ও প্রয়োজনে প্রফেশনাল কাউন্সেলিং।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) এর সাতক্ষীরা জেলা কমিটির সদস্য সচিব এড. মুনিরুদ্দীন বলেন, আত্মহত্যার সংবাদ প্রচারে মিডিয়ার দায়িত্বশীলতা অনেক। কেননা, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ‘অনুকরণ’ করে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি থাকে। যখন কোনো কিশোর-কিশোরীর আত্মহত্যার খবর প্রচারিত হয় দেখা যায়, তখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আবেগীয়ভাবে ঝুঁকিপূর্ণ আরও অনেক কিশোর-কিশোরী একই পদ্ধতি ব্যবহার করে আত্মহত্যা করে বা চেষ্টা করে। তাই পত্রপত্রিকা ও টিভিতে দায়িত্বশীল ও সংবেদনশীল রিপোর্টিংয়ের জন্য ১০টি নীতিমালা ঠিক করা হয়েছে। তিনি বলেন, সুইসাইড নোটের বিবরণী প্রকাশ করা যাবে না। অনুমাননির্ভর কারণ বা উসকে দেওয়া কাহিনি প্রচার করা যাবে না। কিশোর-কিশোরীদের আত্মহত্যা যেহেতু সংক্রামক, তাই তাদের আত্মহত্যার খবর বিশেষ সতর্কতার সাথে প্রকাশ করা উচিৎ।