॥ শেখ মাসুদ আহমেদ ॥
সাতক্ষীরায় জলাবদ্ধ জমিতে পানিফল চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা চিংড়ি উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু বর্তমানে এই জেলার কৃষকরা বিভিন্ন ফল উৎপাদনের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছেন। এর মধ্যে স্বল্প পরিশ্রমে ও অধিক লাভ হওয়ায় পতিত জলাবদ্ধ জমিতে পানিফল চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন কৃষকেরা। এতে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি চাষিদের ঘরে সুদিন ফিরেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার প্রায় ১৫০ হেক্টর জলাবদ্ধ পতিত জমিতে পানিফল চাষ করেছেন প্রান্তিক চাষিরা। উৎপাদিত পানি ফল জেলার চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে রাজধানীসহ দেশের অন্য জেলাগুলোতে। ইতোমধ্যে সাতক্ষীরা জেলার বাজারগুলোতে উঠতে শুরু করেছে পানি ফল। আগাম চাষ করা ফল বিক্রি করে লাভের আশা করছেন চাষীরা। জলের নিচে দুলছে চাষির স্বপ্ন। অন্য ফলের পাশাপাশি পানি ফল বাজার দখল করতে শুরু করায় দিনে দিনে চাহিদাও বাড়ছে। সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ফলটি ছোট বড় সকলের কাছে পছন্দের।
কৃষি অফিসের তথ্য সুত্রে জানা গেছে, এ ফলের ইংরেজি নাম ডধঃবৎ পযবংঃহঁঃ এবং উদ্ভিদতাত্বিক নাম ঞৎধঢ়ধ নরংঢ়রহড়ংধ। পানি ফলের আদিনিবাস ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা হলেও এর প্রথম দেখা পাওয়া যায় উত্তর আমেরিকায়। বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলায় পানি ফলের বাণিজ্যিকভাবে চাষ অনেক আগেই শুরু হয়েছে। পানিফল একটি বর্ষজীবী জলজ উদ্ভিদ। জলাশয় ও বিল-ঝিলে এ ফলটি জন্মে। পানি ফলের এক একটি গাছ প্রায় পাঁচ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। পানি ফলের আরেক নাম ‘পানি সিংড়া’।
কৃষিবিদ ড. এসএম আতিকুল্লাহর মতে, প্রতি-১০০ গ্রাম পানিফলে ৮৪.৯ গ্রাম জলীয় অংশ, মোট খনিজ পদার্থ ০.৯ গ্রাম, ০.৬ গ্রাম আঁশ, ৬৫ কিলো ক্যালরি খাদ্যশক্তি, ২.৫ গ্রাম আমিষ, ০.৯ গ্রাম চর্বি, ১১.৭ গ্রাম শর্করা, ১০ মি. গ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.৮ মিলিগ্রাম লৌহ, ০.১৮ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি-১, ০.০৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি-২ এবং ১৫ মিলি গ্রাম ভিটামিন সি বিদ্যমান থাকে।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, ফল চাষ শুরু হয় ভাদ্র-আশ্বিন মাসে এবং ফল সংগ্রহ করা হয় অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে। পানিফল কচি অবস্থায় লাল, পরে সবুজ এবং পরিপক্ক হলে কালো রং ধারণ করে। ফলটির পুরু নরম খোসা ছাড়ালেই পাওয়া যায় হৃৎপিন্ডাকার বা ত্রিভুজাকৃতির নরম সাদা শাসঁ। কাঁচা ফলের নরম শাঁস খেতে বেশ সুস্বাদু। পানি ফল কাঁচা খাওয়া হয়, তবে সিদ্ধ করেও খাওয়া যায়। কাঁচা পানিফল বলকারক দুর্বল ও অসুস্থ মানুষের জন্য সহজপাঁচ্য খাবার। ফলের শুকনো শাঁস রুটি করে খেলে এলার্জি ও হাত-পা ফোলা রোগ উপশম হয়। পিওপ্রদাহ, উদরাময় ও তলপেটের ব্যথ্যা উপশমে পানিফল খাওয়ায় প্রচলন রয়েছে। বিছাপোকা কামড়ের যন্ত্রণায় থেতলানো কাঁচা ফলের প্রলেপ দিলে উপকার পাওয়া যায়। দেবহাটার সখিপুর গ্রামের পানিফল চাষি আবদুল গফ্ফার জানান, গত কয়েক বছর ধরে আমি পানি ফল চাষ করছি। প্রথমে মানুষের মাঝে তেমন সাড়া পাওনা না গেলেও দিন দিন এর চাহিদা বৃদ্ধি পাঁচ্ছে। পানিফল চাষি শহিদুল ইসলাম জানান, এ বছর তিনি একটি ৫ বিঘা জমি লিজ নিয়ে পানি ফলের চাষ শুরু করেছেন। শুরুতেই এই চাষ লাভের আশা দেখিয়েছেন তাকে। তিনি আগামী বছর আরও বেশি জমি নিয়ে চাষ করবেন বলেও জানান। আরেক পানিফল চাষি শামছুর রহমান বলেন, ১০ বছরের বেশি সময় ধরে পানিফল চাষ করে আসছেন। এবছর তিনি ১০ বিঘা জমিতে এ চাষ করেছেন। বিঘা প্রতি ১৫/২০ মণ ফলন পাঁচ্ছেন। শুরুতেই যার প্রতি কেজি ৪০ টাকা দরে পাইকারি বিক্রয় করে লাভবান হচ্ছেন।
সখিপুর মোড় এলাকার খুচরা পানিফল বিক্রেতা আবদুল গফুর জানান, বর্তমানে তিনি ৪০টাকা কেজিতে ক্রয় করে ৫০টাকা কেজিতে বিক্রয় করছেন। এতে তিনি কেজিতে ১০টাকা হারে লাভ করে দিনে ৫০০/৭০০ টাকা উপার্জন করছেন।
সখিপুর মহিলা কলেজ এলাকার ইমরান হোসেন জানান, প্রতিদিন সকালে চাষিদের কাছ থেকে পানিফল ক্রয় করে সারাদিন ধরে তা বিক্রয় করেন। এ ব্যবসা করে তিনি সাংসারিক চাহিদা মেটাচ্ছেন।
পাইকারি পানিফল ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম জানান, চাষের মৌসুম আসার আগে তিনি অর্ধ শতাধিক চাষীর মাঝে অর্থ বিনিয়োগ করেন। পরবর্তীতে ফলন আসার পরে বাজার দর অনুযায়ী উৎপাদিত ফসল ক্রয় করেন। এভাবে ১০/১২ বছরের বেশি সময় তিনি পানিফল ব্যবসায় নিয়োজিত আছেন। প্রতিদিন তিনি ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, বরগুনা, চিটাগাং, সিলেট, রাজশাহী, বেনাপোল, যশোর, নাটোর, বগুড়া, দর্শনা, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় এ ফল রপ্তানি করেন। বর্তমান জেলার বাইরের বাজার ভেদে পাইকারীভাবে বিক্রি করেন তিনি।
উপণ্ডসহকারী কৃষি অফিসার মোঃ ইউনুস আলী জানান, এবছর দেবহাটাতে আনুমানিক ৫০ হেক্টর জমিতে পানিফল চাষাবাদ করা হচ্ছে। প্রতি বিঘায় ১৫/২০মণ ফলন পেয়ে ২০/২৫ হাজার টাকা লাভবান হবেন কৃষক।এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি অফিসার শওকত ওসমান জানান, পানিফল কৃৃষি খাতে চাষ হিসেবে ধরা না হলেও এটি অতিদ্রুত চাষের খাতে আনা হতে পারে। তাছাড়া অন্য বছরের তুলনায় এবছর আবাদ বেড়েছে। কৃষি অধিদপ্তর থেকে চাষিদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহযোগিতা করা হচ্ছে। এ অবাঞ্চিত ফলটি চাষাবাদে খরচ কম ও অল্প পরিশ্রমে বেশ লাভবান হওয়ায় প্রতিবছর আগ্রহ বেড়ে চলেছে পানি ফল চাষিদের।
জেলা কৃষি অধিদপ্তর খামারবাড়ি সূত্র জানায়, ২০২১-২২ সালে ১০৬ হেক্টর জমিতে ২৭৫৫ মেট্রিক টন পানিফল উৎপাদিত হয়। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ১৪২ হেক্টরে দাঁড়ায়। ২০২৩-২৪ সালে জেলায় প্রায় ১৫০ হেক্টর জমিতে পানিফল চাষ হয়েছে বলে জানায় সূত্রটি।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপণ্ডপরিচালক কৃষিবিদ মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘কর্মসংস্থানের পাশাপাশি স্বল্প সময়ে অত্যন্ত লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা পানিফল চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া, সদর ও দেবহাটা উপজেলায় পানিফলের চাষ হচ্ছে।
##