পলাশ কর্মকার ::
সকালের দূর্বাঘাস ও পত্র-পল্লবে এসেছে শিশিরের ছোঁয়া। রাতের শেষ ভাগে শিশিরের টাপুর-টুপুর মন মাতানো শব্দ পুলকিত করছে প্রকৃতিকে। এ যেন হেমন্তে আগমন বার্তা। তাই শুরু হয়েছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের প্রতীক খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের কাজ। সংশ্লিষ্ট গাছিরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। জানাযায়, ৯০’র দশকের পূর্ব পর্যন্ত খুলনার দক্ষিণাঞ্চলের প্রত্যন্ত অঞ্চল জুড়ে যতদূর চোখ যেত তা ছিল সবুজের মহা সমারোহ। সোনালী ফসলে ভরে থাকত সারা মাঠ। ক্ষেতের ভেঁড়ি বা আইল দিয়ে সারি সারি দেখা মিলত হাজার হাজার খেজুর গাছ। কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে সবকিছুই যেন অতীত। প্রত্যন্ত অঞ্চল জুড়ে সোনালী ধানের পরিবর্তে চাষ হয় বাগদা,গলদা চিংড়ির। বলা চলে নগরায়নের প্রতিযোগিতায় ইট ভাটা ও টালীর কারখানা বিরামহীন গতিতে গিলে খাচ্ছে কালের স্বাক্ষী খেজুর গাছগুলোকে। শীতের সকালে সোনালী রোদে বসে মিষ্টি খেজুরের রসের স্বাদও যেন তাই আজ ভূলতে বসেছে চিরচেনা দক্ষিণ জনপদের মানুষরা। তবুও যেখানে যে গাছগুলো এখনও নিরবে দাঁড়িয়ে আছে সেগুলোকে নিয়েই যেন গাছিদের শুরু হয়েছে অন্য রকম ব্যস্ততা। সব মিলিয়ে শরৎ শেষে হেমন্তের প্রকৃতিই জানান দিচ্ছে শীত এসেছে। কপিলমুনি ও পার্শ্ববতী অঞ্চল জুড়ে ছোট বড় মিলে অসংখ্য লবণ পানির চিংড়ি মাছের ঘের রয়েছে। মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পেয়ে বেড়ে গেছে অম্লতা। বছরের সারাটা সময় জুড়ে একদিকে যেমন খেজুর গাছের প্রতি ভাটা সমূহের চোখ রাঙানি অন্যদিকে পরিবেশ বিপর্যয়ে গাছের অকাল মৃত্যু। সব মিলিয়ে জনপদ থেকে সাবাড় হয়েই চলেছে মিষ্টি রসের অফুরন্ত ভান্ডার খেজুর গাছ। তাই গাছের সাথে সাথে গাছিরাও যেন তাদের পেশা পরিবর্তন করে চলে গেছে অন্য পেশায়। কোন কোন এলাকায় যারা এখনও বাপ-দাদার পেশা আঁকড়ে পড়ে আছে ‘গাছি’র পেশায় তাদেরও যেন যায় যায় অবস্থা। এ প্রসঙ্গে কথা হয় প্রবীণ গাছি সবুর মোড়লের সাথে। কেমন যাচ্ছে তার দিন-কাল এমন প্রশ্ন করতেই যেন বড় একটা দীর্ঘশ্বাস, তার পর ছল-ছল চোখে বললেন, এলাকায় এখন খেজুর গাছই নেই, তাই তাদের আর ভাল থাকা! মাঠের দিকে যাচ্ছেন, সেদিকের মাঠে নাকি এখনও কিছু কিছু গাছ রয়েছে। শীতের আগমনি ধ্বনিতে তারা (খেঁজুর গাছ) নাকি তাদেরকে (গাছিদের) আহ্বান করে রস সংগ্রহ করার জন্য।
প্রসঙ্গত, খেজুর গাছের অগ্রভাগের একটি নির্দিষ্ট অংশ বিশেষ ব্যবস্থায় কেটে ছোট কলসি (ভাড়) বাঁধা হয়। ফোঁটায় ফোঁটায় রসে পূর্ণ হয় সে কলসি। তাই রসের সন্ধানে খেজুর গাছের রস সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন রকমের পরিচর্যা-প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন গাছিরা। যদিও এখন গাছিরা গাছিনী বা তাদের বউদের ছন্দ বা গানের সুরে বলেন না ‘ঠিলে ধুয়ে দে-রে বউ গাছ কাটতে যাব’। ছোট হোক বা বড়, খেজুর গাছে অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়েই রস সংগ্রহের প্রক্রিয়া করতে হয়। কোমরে মোটা রশি বেঁধে গাছে ঝুলে এ কাজ করতে হয়। এছাড়া রস সংগ্রহের পাত্র ভাঁড়, ঠিলে বা কলসি প্রস্তুত করতেও তা নিয়মিত আগুনে পোড়াতে হয়। এলাকাবাসী খেজুর গাছ উজাড়ের জন্য সবচেয়ে বেশী দায়ী করেছেন এলাকার ইট ভাটা ও টালির কারখানা মালিকদেরকে। কেননা খেজুর গাছের চাহিদাটা এসব ভাটা এবং কারখানা গুলোতেই বেশী। নানান কারণে তাই যেন আজ গ্রাম-বাংলা থেকে বিলুপ্ত হতে চলেছে খেজুর গাছ।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, একদা যশোরের পর এ জনপদেই বেশী পরিমাণ খেজুর গাছ ছিল। তাই রসের পাশাপাশি চাহিদাতিরিক্ত গুড়ও উৎপাদিত হত এখান থেকে। বর্তমানে এলাকায় খেজুর গাছের দেখা কম মিললেও বছরের প্রায় সারাটা সময় জুড়ে কৃত্রিম পন্থায় চিনি জ্বালিয়ে তৈরি হয় খেজুরের গুড় বা পাটালি। আমাদের গ্রাম বাংলায় অতীতে খেজুর রসের যে সুখ্যাতি ছিল তা যেন তাই ক্রমেই কমে যাচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন খেজুরের রস বিহীন শীতের সকালই জমত না। সকালের সোনালী রোদে বসে মগ বা গ্লাসে করে মিষ্টি রসে চুমুক না দিলে যেন খালি খালি লাগত। সন্ধ্যা বা সেজো রস ছিল যেন আরো মজাদার। খেজুরের গুড় রসনা বিলাসি বাঙালীর সংস্কৃতিরই যেন একটা অংশ বলে মনে করেন স্থানীয়রা। ক’দিন পরেই প্রতিটি ঘরে খেজুরের রস দিয়ে পিঠা-পুলি-পায়েস তৈরির ধূম পড়বে। এলাকাবাসীর দাবি, খেজুর গাছের অবাধ নিধন বন্ধে সচেতনতার পাশাপাশি এগিয়ে আসুক প্রশাসন। শীতের খেজুরের রসনির্ভর সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায় টিকে থাকুক খেজুর গাছ, টিকে থাকুক গাছি সম্প্রদায়।