অনলাইন ডেস্ক ::
পৃথিবীর সর্ববৃহৎ নিরবিচ্ছিন্ন জোয়ার-ভাটার ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন। প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটারের এই বনের অধিকাংশ অংশ বাংলাদেশের মধ্যে। যার আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার। বনটি শুধু পৃথিবীর মৌলিক বাস্তুসংস্থানই নয়, বিশাল জীববৈচিত্র্যের ভাণ্ডারও।
সুন্দরবন রয়েছে প্রায় ৫ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৯৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ১২৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৫৭৯ প্রজাতির পাখি, ১২৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী ও ৩০ প্রজাতির চিংড়ি মাছ রয়েছে। এই জীববৈচিত্র্যময় ম্যানগ্রোভ বনটি শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য নয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে এ দেশকে রক্ষা করতে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ঘূর্ণিঝড় আম্ফান, সিডর ও আইলার মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে শক্তিশালী ঢাল হিসেবে উপকূলকে রক্ষা করে আসছে। সামনেও এই ধরনের বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে থাকবে। সেজন্য আমাদের উচিৎ এই সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখা।
জলবায়ু পরিবর্তন, প্রতিকূল ও নেতিবাচক পরিস্থিতির কারণে বনের সামগ্রিক জীববৈচিত্র্য এখন সংকটাপন্ন। বনের ভেতর মিষ্টিপানির জলাশয়গুলোতে বেড়েছে লবণাক্ততা। এতে মিষ্টিপানি পানে অভ্যস্ত বাঘসহ বন্যপ্রাণীরা নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায়ই অকালে মারা যাচ্ছে। এছাড়া প্রতিনিয়ত বনখেকোদের আগ্রাসনের ফলে সুন্দরবন আজ হুমকির মুখে। আমরা যদি সুন্দরবনকে বনখেকোদের হাত থেকে রক্ষা না করতে পারি তাহলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমাদের বিপদ আসন্ন।
আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি। বিশ্বজুড়ে এই দিনটি ভালোবাসা দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হলেও সুন্দরবনসংলগ্ন উপকূলের মানুষেরা দিনটিকে ‘সুন্দরবন দিবস’ হিসেবে পালন করেন। বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনকে রক্ষায় জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে খুলনাসহ উপকূলীয় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দুই দশকের বেশি সময় ধরে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।
১৯৯২ সালে সুন্দরবনকে রামসার সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পরবর্তীতে, ১৯৯৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ইউনেস্কো সুন্দরবনকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ এবং জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে দিবসটি পালন করা হয়।
২০০১ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের আওতায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রূপান্তর ও পরশ-এর উদ্যোগে দেশের ৭০টি পরিবেশবাদী সংগঠনের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম জাতীয় সুন্দরবন সম্মেলন। সেই সময় ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘সুন্দরবন দিবস’ ঘোষণা করা হয়। সারা দেশজুড়ে দিবসটি পালন করা হয়।
এই দিনে, সুন্দরবনের গুরুত্ব ও সংরক্ষণ প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা হয়। দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা এবং সংরক্ষণে ভূমিকা রাখার জন্য নানান কর্মসূচি নেওয়া হয়। বরাবরের মতো এবারেও সুন্দরবন দিবসের মূল অনুষ্ঠানটি হবে খুলনায়। সেই হিসেবেই এবার পালিত হচ্ছে ২৫তম সুন্দরবন দিবস।
২০১৯ সালে সুন্দরবনের জন্য ১০টি হুমকি চিহ্নিত করেছিল ইউনেস্কো। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া, দূষণ, অবৈধ তৎপরতা ও পশুর নদের খননকে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এছাড়া বনখেকোদের আগ্রাসনের কারণে সুন্দরবনে দিন দিন কমে প্রাণীর সংখ্যা। তবে ২০২৩ সালের শুমারি অনুযায়ী, বনে চিত্রা হরিণ, বন্য শূকর ও বানরের সংখ্যা বেড়েছে।
এছাড়াও সুন্দরবনের পশ্চিমাঞ্চলের দিকে সুন্দরী গাছের সংখ্যা কমে গেছে। পূর্বাঞ্চলের দিকে সুন্দরীগাছের সংখ্যা বেশি থাকলেও বীজ থেকে নতুন চারা গজানোর পরিমাণ তুলনামূলক অনেক কমে গেছে। পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, গাছের আগা মরা রোগ, অন্য গাছের আধিক্য ও বীজ থেকে গাছের নতুন চারা কম হওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বন বিভাগের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেছেন, ‘সুন্দরবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ সমগ্র দেশের পরিবেশ-প্রতিবেশ। তাই যেকোনো মূল্যে আমাদের প্রাকৃতিক সুরক্ষাদেয়ালকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সেই সঙ্গে সুন্দরবনের ক্ষতি হয়—এমন যেকোনো কর্মকাণ্ড থেকে সরে আসতে হবে।
বন বিভাগ অবশ্য বন্য অপরাধ দমনে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া সুন্দরবন এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব। নাহলে অনেক সুবিধা থেকেই বঞ্চিত হব আমরা।