গোলাম সরোয়ার ::
আবারও পুর্বের রুপে ফিরে গেছে সাতক্ষীরা শহরের প্রাণসায়ের খাল। ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে পুনর্খনন করেও কোনো কাজে আসলো না। বর্তমান এই খালটি অবৈধ দখল এবং আবর্জনা বর্জ নিক্ষেপের কারনে শহরের পরিবেশ মারাত্মক ভাবে দুষণ করছে।
জেলা শহরের বৃহৎতম সুলতানপুর বড় বাজারের মাছ আড়ত ও কসাইখানার প্রতিদিনের নিক্ষিপ্ত বর্জ প্রাণসায়ের খালে ফেলার কারনে মারাত্মক ভাবে পরিবেশ দুষণ করছে। তাছাড়া ওই সব বর্জ আবর্জনা পঁচে ব্যাপক দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এতে করে সুলতানপুর বড় বাজার সংলগ্ন এলাকা ও প্রাণসায়ের খালের দু‘পাশে মানুষজনের বসবাস করা মুশকিল হয়ে পড়েছে।
গতকাল বুধবার দুপুরে সুলতানপুর বড় বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায় পৌর পিলখানার পশু জবাইয়ের পয়লা আবর্জনা ও মাছ বাজারের সমস্ত বর্জ প্রাণসায়ের খালে ফেলে স্তুপ করা হয়েছে। এছাড়া প্রাণসায়ের খাল দখল করে নির্মান করা হয়েছে মাছের কাটা বা আড়তসহ অন্যান্য অবৈধ স্থাপনা।
বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর সাতক্ষীরা জেলার সহকারী পরিচালক সরদার শরীফুল জানান, প্রাণসায়ের খালের দু‘পাশে সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছে করার পাশাপাশি খালের পাড়ে পৌরসভার কোনো ডাসবিন না করার জন্য অনেকবার সুপারিশ করা হয়েছে জেলা প্রশাসক ও পৌর কর্তৃক্ষের নিকট। কিন্ত কোনো সিদ্ধান্তই কাজে আসছেনা। তিনি আরো বলেন, শহরের বুক চিরে এমন সুন্দর একটি খাল আছে যা এ শহরের শোভাবর্ধনে অনন্ন। অথচ সেই খালটি পরিবেশ দুষণ করে শহরবাসির রীতিমত গলার কাটা হয়ে দাড়িয়েছে। তিনি আরো বলেন, ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে গত দুই আড়াই বছর আগে প্রাণসায়ের খালটি পুনখর্নন করা হয়েছে অনেকটা দায়সারাগোছের। যা এখন কোনো কাজে আসছেনা শহরবাসির জন্য।
প্রাণসায়ের খাল পাড়ে অবস্থিত শহরের রাধানগর এলাকার সাতক্ষীরা নৈশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শিখা রানী মন্ডল জানান, প্রাণসায়ের খালের পানি পঁচে মারাত্মক দুর্গন্ধ ছড়ায়। এতে করে ছাত্রছাত্রীরা যেমন অস্বস্থি বোধ করে। অনেকে স্কুলে আসতে চায়না দুর্গন্ধের কারনে। অনেক সময় বমি হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয় ছাত্র বা শিক্ষকদের।
প্রাণসায়ের খাল পাড়ের বাসিন্দা এ্যাডভোকেট দিলীপ কুমার দেব ও মনিরুল ইসলাম জানান, প্রাণসায়ের খালটি পুনর্খনন করেও কোনো কাজে আসলো না। শুধু সরকারের কোটি কোটি টাকাই নষ্ট হলো। পুর্বের রুপে ফিরে গেছে প্রাণসায়ের খাল। বর্জ বা আবর্জনা খালের পানিতে ফেলার কারনে তা পচেঁ আশপাশির পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে। পথচারীরা স্বাচ্ছন্দে চলাচল করতে পারেনা খালের দুর্গন্ধের কারনে।
সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব এ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ জানান, সাতক্ষীরা পৌরসভায় দুই লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। কিন্ত এখানে অপরিকল্পিত ভাবে গড়ে উঠেছে সাতক্ষীরা শহর। তিনি বলেন, প্রাণসায়ের খাল হবে এ শহরের দৃষ্টিনন্দন বা শোভাবর্ধন। এখানে পর্যকটরা আসবে। খালের দু‘পাশে ঘুরা ফেরা আগত পর্যকট। কিন্ত সেখানে আমরা কি দেখছি সাধারণ মানুষ প্রাণসায়ের খালের পাশ দিয়ে চলতে চায়না। কারন খালের পানি পচেঁ দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। পানিতে ভাসছে ময়লা আবর্জনা। খালের দু‘পাড়ে অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এরপরও খালটি পুনর্খননের উদ্যোগ নেয় সরকার। ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রাণসায়ের খাল পুনর্খননের শুরুতে নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্ণীতির অভিযোগ উঠে। একপর্যায়ে খালটির একাংশ বাদ রেখেই খনন শেষ করা হয় ২০২২ সালের দিকে। তার পর থেকে সেই অবস্থায় রয়েছে। সরকারের কোটি কোটি টাকা নষ্ট হলো কিন্ত কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
এব্যাপারে সাতক্ষীরা পৌরসভার পিলখানার দায়িত্ব প্রাপ্ত সেনিটারী ইন্সপেক্টর মোঃ রবিউল ইসলাম জানান, শহরের মাংস ব্যবসায়ীদের নির্দেশ দেয়া আছে পশু জবাইয়ের কোনো ময়লা আবর্জনা প্রাণসায়ের খালে বা আশপাশে ফেলা যাবেনা। কিন্ত যে সব মাংস ব্যবসায়ীরা এ নির্দেশ অমান্য করে প্রাণসায়ের খাল নোংরা করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাছাড়া পৌরসভার নিজস্ব কোনো পিলখানা নেই। এসব মাংস ব্যবসায়ীরা মুলত বিচ্ছিন্ন ভাবে পশু জবাই করে বলে জানান তিনি।
এব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত পৌর মেয়র ও স্থানীয় সরকার সাতক্ষীরা জেলা উপ-পরিচালক মাসরুবা ফেরদাউস জানান, প্রাণসায়ের খালে কোনো প্রকার আবর্জনা যাতে না ফেলে হয় সে জন্য সাতক্ষীরা পৌরসভার পক্ষ থেকে সুন্দরবন ফাউন্ডেশন নামে একটি বর্জ ব্যবস্থাপনা কমিটি করে দেয়া হয়েছে। ওই সংগঠনের সদস্যরা শহরের ময়লা আবর্জা সংগ্রহ করে তা পৌরসভার নির্ধারিত ডাম্পিং স্টেশনে রাখার কথা। কিন্ত তার পরও কেন প্রাণসায়ের খালে আবর্জনা ফেলে পরিবেশ দুষণ করা হচ্ছে সেটা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাছাড়া প্রাণসায়ের খালের পরিবেশ রক্ষা করতে হলে সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই প্রাণসায়ের খালের যেমন সুন্দর্য্য বৃদ্ধি পাবে, তেমনি শহরের পরিবেশও ভালো হবে বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, বৃটিশ শাসনামলের ১৮৬৫ সালে ততকালিন সাতক্ষীরার জমিদার প্রানণাথ রায় চৌধুরী পরিচ্চাপ নদীর সাথে সংযোগ রেখে খনন করেন ১৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ এবং ২০০ ফুট প্রস্থ করে প্রানসায়ের খাল। পরবর্তীতে প্রাণসায়ের খাল কেন্দ্র গড়ে উঠে সাতক্ষীরাতে ব্যবসা বানিজ্য। সরাসরী কলকাতা থেকে মালামাল বোঝাই বড় বড় নৌকা ও লঞ্চ চলাচল করতো এই প্রাণসায়ের খাল দিয়ে। এছাড়া দক্ষিনপশ্চিমাঞ্চলের অনেক জেলার সাথে নৌপথে যাতয়াতের মাধ্যম ছিলো এই প্রাণসায়ের খাল। #