ডেস্ক রিপোর্ট ::
সমাজ ও পরিবারের নানা বাঁধা কাটিয়ে জীবন সংগ্রামে সাফল্য অর্জন করেছেন সাতক্ষীরার তালা উপজেলার ৫নারী। নানা বাঁধা বিপত্তিকে পায়ে মাড়িয়ে তৃণমূল থেকে উঠে আসা এসব নারীদের খুঁজে বের করে জয়ীতা অন্বেষনে বাংলাদেশ শীর্ষক কর্মসূচীর আওতায় ৫টি ক্যাটাগরীতে সম্মাননা দিয়েছে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর। বেগম রোকেয়া দিবসে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে তাদেরকে অনুকরণীয় করে রাখতে এ সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। এ সকল নারীদের প্রত্যেকের জীবনে রয়েছে অসীম আত্মশক্তি ও সংগ্রামের আলাদা আলাদা জীবন কাহিনী। তাদের সেই সংগ্রামী জীবনের কিছু তথ্য পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:
অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী রাফিজা খাতুন: জীবন সংগ্রামে দারিদ্রতাকে পিছনে ফেলে সাফল্য অর্জন করেছেন রাফিজা খাতুন। তিনি তালা উপজেলার জেঠুয়া গ্রামের শেখ শাহিদুল ইসলামের স্ত্রী এবং ভায়ড়া গ্রামের শেখ নওশের আলীর গ্রামের কন্যা। জীবনের শুরুতেই ধাক্কা লাগে রাফিজার জীবনে। মাত্র ১৫বছর বয়সে এসএসসি পাসের পূর্বেই ২০০৬ সালের ৩ মার্চ তার বিয়ে হয়। বিয়ের মাত্র এক বছরের মাথায় মাতৃস্বাদ গ্রহণ এবং এর কিছুদিন পরেই স্বামী রোজগারের জন্য দেশের বাইরে পাড়ি জমান। শুরু হয় রাফিজার জীবনের নতুন অধ্যায়। স্বামী দেশের বাইরে থাকায় শত চেষ্টা করেও শ^শুর বাড়িতে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পেরে ফিরে যান বা-বাবার সংসারে। ছোট বেলার স্বপ্ন পূরণ ও নিজেকে স্বাবলম্বী করতে ২০০৯ সালে মায়ের কাছ থেকে ৫৪হাজার টাকা নিয়ে স্থাপন করেন বিউটি পার্লার। যার নামকরণ করা হয় ‘প্রভা বিউটি পার্লার’। এ সময় তার মা ছাড়া কেউই উৎসাহ প্রদান করেনি। পার্লার ব্যবসা ভালই চলছিল। দুই বছরের মাথায় রাফিজার পিতা স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। পিতার কোন পুত্র সন্তান ছিল না। সে সময় পিতার চিকিৎসার জন্য প্রায় ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা ব্যয় করেন তিনি। পার্লারের উপার্জনের টাকা দিয়েই তিনি পিতার চিকিসার ব্যয়ভার বহন করেন। বর্তমানে পার্লারটিতে ৮ লক্ষাধিক টাকা বিনেয়োগের পাশাপাশি ৩ জন কর্মী রয়েছে। পার্লারের ব্যবসা করে নগদ ১৫ লক্ষ টাকা পুঁজির পাশাপাশি তিন শতাংশ জমি ক্রয় করেছেন, যার মূল্য প্রায় ৪৫ লক্ষ টাকা। পার্লার ব্যবসার কারণে প্রতিবেশীদের বিভিন্ন ধরনের কটুকথা ও বাকা উক্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে। এছাড়া শ^শুর বাড়ির অবহেলা ও অসহযোগিতার মধ্যে দুটি সন্তান সামলিয়ে এই কাজে মনযোগ দিতে হয়। বিউটিশিয়ান ডিপ্লোমা কোর্সটি জীবন বদলে দিয়েছে বলে জানান রাফিজা খাতুন। বর্তমানে তিনি ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক তৈরির পাশাপাশি বাংলাদেশ নারী উদ্যোক্তা সোসাইটির সাতক্ষীরা জেলা সমন্বয়বারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। স্বামী-সন্তান নিয়ে বর্তমানে সুখে শান্তিতে জীবন যাপন করছেন অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী রাফিজা খাতুন।
শিক্ষা ও চাকরিক্ষেত্রে সফল নারী বিপাশা বিশ^াস: শিক্ষা ও চাকরিক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী বিপাশা বিশ^াস। একজন শিশুকন্যা থেকে সফল নারী হয়ে ওঠা বিপাশা বিশ^াস ১৯৯০ সালের ২৩ অক্টোবর তালা উপজেলার সেনেরগাঁতী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা জগত রতন বিশ^াস ও মা সীমা বিশ^াস। তিন বোনের মধ্যে তিনি সকলের ছোট। বিপাশা বিশ^াসের বাবা ছিলেন একজন কৃষক। মা-বাবা, তিন বোন, জ্যেঠা, কাকা ও ঠাকুমাকে নিয়ে ছিল তাদের সংসার। বাবাই ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। বাবার সাথে মাঝে মধ্যে ক্ষেত খামারের কাজও করতে হতো বিপাশার। পরার মতো জামা-জুতাও ছিলনা তার। মা-ই ছিল তাদের গৃহ শিক্ষক। তার বড়বোন ছিলেন খুবই মেধাবী। কিন্তু আর্থিক অস্বচ্ছলতা ও পারিপাশির্^ক অবস্থার কারণে সে বিশ^াবিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেনি। গ্রামের অন্যান্য নারীদের প্রতি সংঘটিত অন্যায্যত, বৈষম্য এবং পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা তাকে সর্বদা আহত ও তাড়িত করতো। কিন্তু তার মা তাকে সকল প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে লেখাপড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। ২০১০ সালে তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সেপ্টেম্বর মাসে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। চাকরির পাশাপাশি তিনি পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে থাকেন। একসঙ্গে চাকরি ও পাড়াশুনা করতে গিয়ে তিনি হাঁপিয়ে উঠছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাকরিটা ছেড়ে দিলে লোকজনের কটু কথায় মানসিকভাবে বিপর্যস্থ হযে পড়েন। এদিকে ২০১৫ সালে ৩৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পাশ করে এক বান্ধবীর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে বই কিনে ভাইভার প্রস্তুতি নেন। পাশাপাশি একটা টিউশন পেয়ে যান। চাকরি না পেলে পরিবারের সামনে মুখ দেখাবে কেমনে এই চিন্তায় তার হতাশা বেড়ে যায়। অবশেষে ২০১৭ সালের ১৭ অক্টোবর ৩৬তম বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। ২০১৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি সাতক্ষীরা সরকারি মহিলা কলেজে দর্শন বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে কর্মরত আছেন। তারা তিন বোনই এখন সরকারি চাকুরী কবরেন। ভবিষ্যৎ উচ্চতর ডিগ্রী ও গবেষণার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চান বিপাশা বিশ^াস।
সফল জননী সালেহা বেগম: সফল জননী নারী হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সালেহা বেগম। তিনি তালা সদর ইউনিয়নের মুড়াকলিয়া গ্রামের আবুল হোসেন সরদারের কন্যা। মাত্র ৬ মাস বয়সেই মাকে হারান সালেহা। এরপর সৎ মায়ের সংসারে অযতেœ অবহেলায় দিন কাটে তার। এক পর্যায়ে বাবা তাকে রেখে আসেন নানা বাড়িতে। সেখানে অর্দাহারে অনাহারে বড় হতে থাকে সালেহা। ভর্তি হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কিন্তু লেখাপড়ার প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ১৯৭৩ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের নওয়াপাড়া গ্রামের বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী আব্দুস সামাদ মোড়লের সাথে তার বিয়ে হয়। বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী স্বামীকে নিয়ে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েন। বিয়ের ২ বছরের মাথায় কোলে আসে ফুটফুটে কন্যা। এরপর জন্ম হয় আরো তিন সন্তানের। তিন কন্য, এক পুত্র ও প্রতিবন্ধী স্বামীকে নিয়ে জীবন সংগ্রাম শুরু করেন তিনি। তাঁর প্রথম কন্যা জাহানারা খাতুন পড়াশুনা শেষ করে পাটকেলঘাটা হারুণ অর রশিদ কলেজে জীববিজ্ঞানের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস প্রায় ৪ চার আগে তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। মেঝ কন্যা তাহেরা পারভীন বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার, একমাত্র পুত্র শরীফ হাসান পড়ালেখা শেষ করে একটি কোম্পানীতে এবং ছোট কন্যা মিনা সুলতানা মাধ্যমিক পর্যায়ে নিবন্ধন পরীক্ষায় সুপারিশকৃত হয়েছেন। সালেহা বেগমের অক্লান্ত পরিশ্রমেই এই সাফল্য। তিনি এখন পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করছেন।
নির্যাতিতা থেকে উদ্যোমী, কর্মঠ ও স্বাবলম্বী নারী কোহিনুর বেগম: নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নব উদ্যমে জীবন শুরু করা নারী মোছা: কোহিনুর বেগম। তিনি তালা উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের ধলবাড়িয়া গ্রামের মো: আমিনুদ্দীন শেখের কন্যা। হতদরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা কোহিনুর বেগমের মাত্র ১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয় পাশর্^বর্তী নওয়াপাড়া গ্রামের মুন্তাজ আলী সরদারের সাথে। অক্ষম স্বামীর কোন জায়গা জমিও ছিল না। এক পর্যায়ে অভাবের যন্ত্রণায় আড়াই বছরের শিশুসহ স্ত্রীকে রেখে তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান। অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে সন্তানকে মানুষ করেন তিনি। তার সন্তান বর্তমানে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে চাকুরী করেন। কোহিনুর বেগমের প্রবল ইচ্ছা ও প্রচেষ্টার কারণে তার সন্তান আজ প্রতিষ্ঠিত।
সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন ফিরোজা খাতুন: একজন নারী হয়েও জীবন সংগ্রামের মাঝে সমাজের উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন ফিরোজা খাতুন। তিনি উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নের আমড়াডাংগা গ্রামের আব্দুল গফ্ফার শেখের স্ত্রী। তার বাবার বাড়ি খেশরা ইউনিয়নের শাহ্পুর গ্রামে। ৮ম শ্রেণিতে পড়ার সময় পিতা তাকে বিয়ে দেন। মাত্র ৫ শতাংশ বসতভিটা ছাড়া স্বামীর কোন জমি নেই। অন্যের জমিতে কাজ করে চলে তাদের সংসার। বর্তমানে তাদের দুই পুত্র সন্তান রয়েছে। ছেলেদের স্কুলের দেয়ার পর সংসারের খরচ কিছুটা বেড়ে যায়।
তখন তিনি একটি পুরাতন সেলাই মেশিন কিনে হাতের কাজ শিখে কাজ করতে থাকেন। সংসারেও একটু স্বচ্ছলতা ফিরে আসে। এরই মধ্যে তিনি উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশও করেন। ধীরে ধীরে সমাজের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হন ফিরোজা খাতুন। এক পর্যায়ে সমাজে তার গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যায়। এলাকাবাসীর কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার কারণে তিনি ২০২১ সালে তালা উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নের ৭,৮ ও ৯নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচন করে বিপুল ভোটে জয়ী হন। বাকি জীবন জনগণের সেবার লক্ষ্যেই তিনি কাজ করে যাবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।