অনলাইন ডেস্ক ::
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৩৮ দিন পর রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মেরূকরণের আভাস মিলেছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে এক দফা আন্দোলন করতে গিয়ে নাশকতার মামলায় গণহারে গ্রেপ্তারকৃত শীর্ষস্থানীয় নেতারা মুক্তি পেতে শুরু করেছেন। গ্রেপ্তারের সাড়ে তিন মাস পর জামিনে মুক্তি পেলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। গতকাল বৃহস্পতিবার কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে মুক্তি পান দলটির দুই শীর্ষ নেতা। প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা মামলায় মুক্তি পাওয়ার পর দুই নেতাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান দলটির নেতাকর্মীরা। এ সময় কারা ফটকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, একপক্ষীয় নির্বাচন করে সরকারই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনার আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। নেতাকর্মীর হতাশার কিছু নেই। ৭ জানুয়ারির একপক্ষীয় নির্বাচন করে সরকারই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিএনপির কোনো ক্ষতি হয়নি।
হাত নেড়ে নেতাকর্মীর শুভেচ্ছার জবাব দিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, বাংলাদেশের জনগণ সব সময় গণতন্ত্রের জন্য, ভোটের অধিকারের জন্য, ভাতের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছে, লড়াই করেছে। এই সংগ্রামে তারা জয়ী হবে। বিজয় না হওয়া পর্যন্ত্র ‘গণতন্ত্র ফেরানোর আন্দোলন’ অব্যাহত রাখার দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেন মির্জা ফখরুল।
এ সময় অপর নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘ওরা রাষ্ট্র শক্তিকে কবজা করে ক্ষমতা দখল করেছে, বাংলাদেশের মানুষ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা নির্বাচনে নৈতিকভাবে জনগণের কাছে পরাজিত হয়েছে। গণতন্ত্রের আন্দোলন অটুট থাকবে। যতদিন দেশে গণতন্ত্র ফেরত না আসবে, জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার না আসবে, ততদিন এই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।
কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে সরাসরি সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে যান বিএনপি মহাসচিব। সেখানে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে ভার্চুয়ালি শুভেচ্ছা বিনিময় করেন তিনি। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা বিজন কান্তি সরকার, কোষাধ্যক্ষ রাশিদুজ্জামান মিল্লাত, স্থানীয় সরকার বিষয়ক সহ-সম্পাদক শাম্মি আক্তার, চেয়ারপারসনের একান্ত সচিব এবিএম আব্দুস সাত্তারসহ বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে নিজ বাসভবনে যান মির্জা ফখরুল।
নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে বিগত কয়েক বছর ধরে আন্দোলন করছে বিএনপি। সেই আন্দোলনের চূড়ান্ত মুহূর্তে গত ২৮ অক্টোবর ঢাকার নয়াপল্টনে দলটির মহাসমাবেশ পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে পণ্ড হয়ে যায়। সেখান থেকেই রাজপথে হরতালের মতো কঠোর আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপি মহাসচিব। এর পরদিন ২৯ অক্টোবর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। অন্যদিকে ২ নভেম্বর গ্রেপ্তার করা হয় আমীর খসরুকে। বিএনপির মহাসমাবেশের দিন প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনায় তাদের গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। গত ৭ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানা রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের পর গতকাল মুক্তি পান বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা।
একই দিন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন দলটির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক এবং বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য সচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী। তাঁকে ১০ অক্টোবর রাতে তাঁর ধানমন্ডির বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
কারাফটকের সামনে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক কামরুজ্জামান রতন, সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু, সহপ্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম, ঢাকা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নিপুণ রায় চৌধুরী, বিএনপি নেতা ফরহাদ হোসেন আজাদ, সাবেক এমপি আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়মসহ অঙ্গসংগঠনের কয়েকশ নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে দুই নেতার গাড়ি ঘিরে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। দুই শীর্ষ নেতার পরিবারের মধ্যে মির্জা ফখরুলকে বাড়ি নিয়ে যেতে কারাগারের ফটকে উপস্থিত হয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী রাহাত আরা বেগম আর আমীর খসরুকে নিতে এসেছিলেন তাঁর ছেলে ইস্রাফিল খসরু।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে গত ২৮ অক্টোবর এবং এর পরের সংঘর্ষ ও সহিংসতাকে কেন্দ্র করে ১১টি মামলা হয়। আগেই ১০টিতে তিনি জামিন পেয়েছেন। প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার মামলায় তাঁর জামিন গত বুধবার মঞ্জুর করেন আদালত। অন্যদিকে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১০টি মামলা হয়। আগে তিনি ৯টি মামলায় জামিন পান। তিনিও বুধবার প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার মামলায় জামিন পান।
সব মামলায় জামিন পেলেও আইনি জটিলতায় তাদের মুক্তিতে বিলম্ব ঘটতে থাকে। তবে আইনজীবীদের তৎপরতায় বিকেলের মধ্যে কারামুক্তি পান দলের দুই শীর্ষ নেতা। আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ও অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার জানান, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সব মামলার জামিনের পর ‘প্রডাকশন ওয়ারেন্ট-পিডব্লিউ’ প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শেষ করে কাগজপত্র কারাগারে যাওয়ার পর ওই দুই নেতার মুক্তি মেলে। অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার জানান, বিএনপি মহাসচিবের ১৩টি মামলায় প্রডাকশন ওয়ারেন্ট ছিল। নির্বাচনের পর বিরোধী দলের নেতাকর্মীর ধারাবাহিক জামিন প্রক্রিয়ায় মুক্তি পেলেন দলটির দুই হেভিওয়েট নেতা।
অবশ্য এখনও দলটির আরও বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা কারাগারে আছেন। তাদের মুক্তির প্রক্রিয়াও দ্রুত সম্পন্ন হবে বলে আশা করছেন আইনজীবীরা। কারাবন্দি নেতাদের মধ্যে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, হাবিবুর রহমান হাবিব, আতাউর রহমান ঢালী, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহিরউদ্দিন স্বপন, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নীরব, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনু, বিএনপির নির্বাহী সদস্য শেখ রবিউল আলম রবি, যুবদলের সাবেক সহসভাপতি এসএম জাহাঙ্গীর, মহানগর উত্তর বিএনপির সাবেক নেতা ও সাবেক কমিশনার শামীম পারভেজ, স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় নেতা আজিজুর রহমান মুসাব্বিরসহ আরও অনেকে রয়েছেন। বেশির ভাগ নেতাকেই ২৮ অক্টোবরকে কেন্দ্র করে নাশকতার অভিযোগে ঢাকায় বিভিন্ন থানায় দায়েরকৃত মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া নাশকতার মামলায় সারাদেশে ২৭ হাজার বিএনপি নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন বলে দাবি করে আসছে বিএনপি।
এর মধ্যে গতকাল বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী রাজধানীর রমনা মডেল থানায় নাশকতার মামলায় জামিন পেয়েছেন। ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম মো. সুলতান সোহাগ উদ্দিন শুনানি শেষে জামিনের আদেশ দেন। আসামিপক্ষের আইনজীবী তাহেরুল ইসলাম তৌহিদ জানান, এর আগে বেশ কয়েকটি মামলায় জামিন পান আলতাফ হোসেন চৌধুরী। তবে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার মামলায় এবং আরেকটি নাশকতার মামলায় সাজা হওয়ায় কারাগারে আছেন তিনি। এ জন্য তাঁর কারামুক্তি মিলছে না।