ডেস্ক রিপোর্ট ::
বই মেলা প্রাঙ্গণে বিচিত্র প্রকরণের অগণিত বইয়ের সমাবেশ ঘটায় ক্রেতাদের পক্ষে বিভিন্ন স্টল ঘুরে রুচি ও পছন্দ অনুযায়ী বই নির্বাচন সহজ হয়। মেলার সাজোয়া বর্ণাঢ্য উন্মুক্ত পরিবেশে লেখক, প্রকাশক ও পাঠক বা ক্রেতাদের মধ্যে সরাসরি ভাববিনিময় ও আন্ত:সম্পর্কের অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হয়। তাই বইয়ের টানের সাথে মেলার আকর্ষণ নবতর প্রাণশক্তির এক অনাবিল আনন্দস্রোতে অবগাহনের শিহরণ জাগায়। যুগের যান্ত্রিকতায় বই মেলা অনগ্রসরতা, অজ্ঞতা, অসচেতনতা ও পাঠবিমুখতার কারণে আমাদের এ আঞ্চলে (পূর্ববাংলায়) বইমেলার প্রচলন ততটা প্রাচীন না হলেও বিশেষত দেশ স্বাধীনের পর তা নিয়ে প্রভূত উৎসাহ-উদ্দীপনা তথা আয়োজন লক্ষণীয়। হয়ত অত্যন্ত তাৎপর্যম-িত এ বিষয়টির প্রতি বিদ্যোৎসাহীদের আগ্রহ, কৌতূহল ও অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিবদ্ধের কারেণে এর অবাধ দূয়ার উন্মোচিত হয়েছে। তাই প্রতি বছর বিশেষ ঘটা ও নিয়ম করে প্রধানত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ বই মেলাটি বেশ আড়ম্বরী তোড়জোড়ে জাকজমকভাবে পালিত ও উদযাপিত হয়ে আসছে। এছাড়া ঐ একই মাসে বা বছরের সুবিধা মত সময়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা-উপজেলা শহরে বইমেলার আয়োজন পালিত হয়ে আসছে।
বাংলাদেশের নৈঋত (দক্ষিণ-পশ্চিম) প্রান্তে আবস্থিত সুন্দরবন সংলগ্ন একটি প্রান্তিক জেলা সাতক্ষীরা। প্রান্তিকতা তার প্রকৃতি আর জীবনের স্বাভাবিক বিন্যাস ও বৈচিত্রে উদ্ভাসিত। জীবন-জীবিকা প্রবাহে সুখ-দুঃখের ছন্দময় লীলামাধুরীতে এর প্রভাব সতত সঞ্চারিত। বর্ণাঢ্য সম্ভাবনাতে, সম্পদে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে, কৃষ্টি-সভ্যতা-ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। বুড়োন পরগনার পরিচিতি ধরে অনেক গৌরব উজ্জ্বল কর্মকা-ে ও পৌরাণিক আদি উপাখ্যানে এ অঞ্চলের উল্লেখ মেলে। ব্রিটিশ যুগে বাঙালি জনপদেও শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মীয় তথা সামগ্রিক সামাজিক উন্নয়নের প্রাণকেন্দ্র ছিলো কোলকাতা (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)। সাতক্ষীরা সে প্রাণকেন্দ্রের খুব কাছে হওয়ায় এখানকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কীর্তিময়, আভিজাত্য ম-িত ও বৈচিত্র্য বৈভবে প্রতিফলিত। স্বাধীন বাংলাদেশের উত্থানের পর সাতক্ষীরা কেন্দ্রিয় পাবলিক লাইব্রেরি এবং সাতক্ষীরা জেলা সাংস্কৃতিক পরিষদ তারই ধারাবাহিকতায় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করে। স্বাধীনতার স্বতন্ত্রে, নতুন ঠিকানায়, নতুন পরিচয়ে সাতক্ষীরার উৎসাহী সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুরাগীদের স্বত:স্ফূর্ত প্রয়াস ও উদ্যোগে সবকিছু যেন আবার প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। তবে সে প্রক্রিয়ায় বইমেলার প্রচলনটা প্রচলিত হয় বেশ পরে। এখানে নানা কারণে বইমেলা আসলে প্রতি বছর সময়, দিন-ক্ষণ নির্ধারন করে নিয়ম মেনে অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে ঢাকা বই মেলার মত এখানে ফেব্রুয়ারি মাসের স্থায়ী কোন দিন-ক্ষণ নির্ধারনের প্রচলন থাকলে প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে তা অধিককর ইতিবাচক হত।
১৯৯১ সালে কেন্দ্রিয় পাবলিক লাইব্রেরি’র উদ্যোগে লাইব্রেরি কক্ষে অস্থায়ী পার্টিশান দিয়ে বইমেলার প্রথম গোড়াপত্তন ঘটে। ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৯দিনব্যপি এ মেলা চলে। কেন্দ্রিয় পাবলিক লাইব্রেরি, ইসলামিক ফাউ-েশন ও স্থানীয় কিছু সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন (তন্বী, ঈক্ষণ, গ্রন্থ বিতান) এ আয়োজনে অংশগ্রহণ করে। আয়োজনটির পরিসর ক্ষুদ্র হলেও এর পাশাপাশি সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হওয়ায় ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক-অভিভাবকসহ সকল শ্রেনির দর্শকের উপস্থিতিতে জমজমাট হয়ে ওঠে। তাছাড়া বইমেলা প্রবর্তনের শুভ সূচনা হিসেবে এর গুরুত্ব অপরিসীম। পরবর্তী বছর ১৯৯২ সালে কেন্দ্রিয় পাবলিক লাইব্রেরিতে ১৯ জানুয়ারি থেকে ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত ০৩ দিন ব্যপী বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলাটি চলে ‘পুঁথিঘর’ (পাঠ্যপুস্তক) ও ‘মুক্তধারা’ (সৃজণশীল) প্রকাশনীর স্বত্ত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহা’র একক উদ্যোগ ও অংশগ্রহণে। এ মেলাটিও উৎসাহী দর্শক-ক্রেতার ভিড়ে জমজমাট হয়ে উঠে। ঐ একই বছর (১৯৯২) ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ০৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৭ দিনব্যাপী একই ভেনুতে কেন্দ্রিয় পাবলিক লাইব্রেরির উদ্যোগ ও আয়োজনে বইমেলার আসর বসে। মেলাটি সাতক্ষীরাবসীর কাছে সমগুরুত্ব ও আগ্রহের সাথে সমাদৃত হয়। ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে লাইব্রেরির সংগঠনিক জটিলতায় (সাধারণ সম্পাদকের মৃত্যুজনিত) বইমেলার ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়। ১৯৯৫ সালে লাইব্রেরির উদ্যোগে বইমেলার আয়োজন চলে। এ মেলাটিতে ইসলামিক ফাউ-েশন, শিশু একাডেমিসহ সাতক্ষীরার ‘পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির পক্ষ থেকে কয়েকটি স্টল বরাদ্দের মাধ্যমে বইমেলাটি সুসম্পন্ন হয়। আর ঐবছর থেকেই বইমেলা লাইব্রেরির ভিতর থেকে বেরিয়ে সম্মুখ চত্বরের উন্মুক্ত পরিবেশে পৃথক-পৃথক স্টল নির্মাণের মাধ্যমে স্ব-স্ব আঙ্গিক সাজ-সজ্জায় অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বন্যাজনিত অস্থিরতা ও নানান অস্থিতিশীলতার কারণে বইমেলা আয়োজনের ধারাটি সাময়িক স্তব্ধ রয়ে যায়। ২০০২ সালে আবার বইমেলা উদ্যাপিত হয়। এরপর থেকে স্থানীয় ‘পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি’ অনেকটা প্রভাবী ও কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠায় মূল উদ্যোক্তা হিসেবে পাবলিক লাইব্রেরি এবং প্রশাসনের সাথে সমন্বয়হীনতার কারণে ২০০৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বইমেলার কার্যক্রম বন্ধ থাকে। ২০১০ সালে জেলা প্রশাসক জনাব আবদুস সামাদ মহোদয়ের সরাসরি হস্তক্ষেপ ও তত্ত্বাবধানে এ সংক্রান্ত বিবাদের অবসান হয়। তিনি লাইব্রেরি সংশ্লিষ্টদেরকে সাথে নিয়ে বইমেলা আয়োজনের উদ্যোগ শুরুকরে।
২০১০ সালে কেন্দ্রিয় পাবলিক লাইব্রেরির সম্মুখ চত্বরে এবং ২০১১ সালে জেলা শিল্পকলা একডেমি চত্বরে বইমেলার জমজমাট আয়োজন চলে। ২০১২ ও ২০১৩ সালে ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, আইলাজনিত অস্থিরতায় বইমেলা আবার বন্ধ রাখা হয়। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে যথানিয়মে বইমেলা চলে। ২০১৬-২০১৭ সালে মূল উদ্যোক্তার ভূমিকায় থাকা কেন্দ্রিয় পাবলিক লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষের বই মেলার ব্যাপারে কোন সাড়া মেলেনি। যার কোন সঙ্গত কারণও জানা যায়নি। ২০১৮ সালে অনেকটা সংক্ষিপ্ত ও দায়সারা ভাবে ক্ষুদ্র পরিসরে (১টি স্টলে) সাতক্ষীরার কয়েকজন লেখকের প্রকাশিত বই বিক্রয় ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ। যেটাকে কোন বইমেলা বা বইমেলার বিকল্প ভাবার সুযোগ আছে কিনা জানিনা। তাছাড়া সুসমন্বয়হীন ও আকস্মিক সিদ্ধান্তের কারণে যাথাযথ প্রচার-প্রসারের অভাবে এ আয়োজনটি জমজমাট হতে পারেনি। সাতক্ষীরার বইমেলা আয়োজনে ধারাবাহিকতা ও ব্যবস্থাপনার কিছু ছন্দপতন ঘটলেও আসলে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত উদ্যোক্তা, পৃষ্ঠপোষকতা ও তত্ত্বাবধানে প্রশাসনিক সম্পৃক্ততা ছিলোনা। কার্যত ১৯৯৫ সাল থেকে মেলার তদারকি, প্রস্তুতি ও পর্যালোচনায় প্রশাসনের সরাসরি ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়।
২০১৯ সালের দুইটি বইমেলার আয়োজন হয়। এ দুটি মেলা সম্পর্কে একটু আদালাভাবে বলার দাবি রাখে। কারণ এদু’টি সাতক্ষীরার বইমেলার ইতিহাসে রেকর্ড ভঙ্গকারী মেলা। আসলে সৌভাগ্যবশত এ সময়ে আমরা জেলা প্রশাসক হিসেবে পেয়ে যাই এস এম মোস্তফা কামাল মহোদয়কে, যিনি বাঙালি জাতিস্বত্তা লালনকারী অত্যন্ত সৃজনশীল ও সাহিত্য-সংস্কৃিত প্রেমি মানুষ। তিনি প্রায়ই বলেন- ‘আমি ব্যতিক্রমে বিশ^াসী, তাই অপেক্ষাকৃত ভালো ও ভিন্ন আমেজ সৃষ্টি করতে না পারলে তা আমি করি না। তাছাড়া সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সৃজনশীলতা আমাকে টানে। অক্লান্ত পরিশ্রমের পরও যখন আমি এমন কোন পরিম-লে যাই বা এ অঙ্গনের মানুষের সাহচর্য পাই, তখন কি এক অদ্ভূত অক্সিজেনের আবেশে তৎক্ষণাৎ সব ক্লান্তি নাশ হয়ে যায়।’ প্রথম মেলা ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ দিবস থেকে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্ম ও জাতীয় শিশুদিবস পর্যন্ত চলে। এ বইমেলার সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সাথে দিবস দু’টির ঐতিহাসিক তাৎপর্য তুলে ধরার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বই মেলার জন্য মনোনীত এই মাস এবং শুরু ও সমাপ্তির দিনক্ষণটি মেলাটিকে কয়েকটি বাড়তিমাত্রায় মহিমান্বিত করে তোলে, যা এ জনপদে ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক পরিচিতি অবহিত এবং আন্ত:সম্পর্ক নিবিড় ও মজবুত করতে ভূমিকা রাখে। ১১দিনব্যপী বইমেলার জন্য এই প্রথম ঢাকার পঞ্চাশটি খ্যাতিমান প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। গৌরবময় অতীত ঐতিহ্যে লালিত ও সমৃদ্ধ সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন কর্মযজ্ঞে চলমান ধারায় সাতক্ষীরাতে প্রথম একটি অধিকতর ফলপ্রসূ বইমেলার সার্থক আয়োজন পেয়েছি। তাই সঙ্গত কারণে এর আঙ্গিক সমৃদ্ধি, প্রসার, পরিসর ভিন্ন। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এঁর চেতনাকে সর্বস্তরে ধারণ করতে প্রজ্ঞার শৈল্পিক দক্ষতা দিয়ে জেলা প্রশাসক মহোদয় মূল উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন। আর তাই তিনি স্বতপ্রণোদিত হয়ে সংশ্লিষ্টদের সাথে নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন বইমেলা মতো সময়োপযোগী বাস্তব ও গঠনমূলক কিছু প্রসঙ্গিক পদক্ষেপ, পরিকল্পনা, নির্দেশনা নিয়ে। যার পৃষ্ঠপোষকতা আর নিয়মিত তদারকিতে সে বার আমরা একটি কাঙ্খিত কার্যকরী, ফলপ্রসূ ও সার্থক বইমেলার সফল বাস্তবায়ন ঘটাতে পেরেছি। যা এ নৈঋত সীমান্ত মফস্বলের প্রেক্ষাপটে একটি উন্নত বইমেলার আমেজ-মেজাজে পরিপুষ্ট। তাই অপেক্ষাকৃত নতুনত্বে এমন একটি বইমেলা উপহার পেয়ে সাতক্ষীরাবাসী মুগ্ধ, পুলোকিত।
একই সালের অর্থাৎ ২০১৯ সালে দ্বিতীয় বইমেলাটি আরও বর্ণাঢ্য ও আকর্ষণীয় আয়োজনে সাতক্ষীরাবাসীকে ঋদ্ধ করেছে। যা সাতক্ষীরার সর্বস্তরের দর্শক-ক্রেতার কাছে বইমেলার চিরাচারিত ধারার অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধিকে আরও একধাপ এগিয়ে দেয়। ঢাকা থেকে খ্যাতিমান ৫৪টি পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান এ মেলায় অংশ নেয়। অংশ নিয়েছে নজরুল ইনস্টিটিউট, বাংলদেশ চলচিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, জাতীয় গ্রন্থাগার, বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, ইসলামিক ফাউ-েশন, মহিলা অধিদপ্তর, পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতি (পুনাক)’সহ রাষ্ট্রায়ত্ত কিছু প্রকাশনা সংস্থার পাশাপাশি প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সংগঠন, সংস্থা এ মেলায় অংশ নেয়। ৭০টি পরিপাটি ও সাজোয়া বইয়ের স্টল শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কের পুরো মাঠজুড়ে বিরাজমান। এই প্রথম মেলা প্রাঙ্গণে নিরাপত্তার জন্য স্থায়ী পুলিশ বক্স, স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র ও সুপেয় পানি পানের ব্যবস্থা, অনুসন্ধান বা তথ্য পাওয়ার জন্য ইনফরমেশন বুথ এর ব্যবস্থা রাখা হয়। বই কেনায় উৎসাহিত করার জন্য প্রতি দুইশত টাকা মূল্যের বই ক্রয়ের বিনিময়ে একটি করে কুপন দেওয়া হয়। দামি ও আকর্ষণীয় উপহার সংবলিত এসব কূপনের ড্র অনুষ্ঠিত হয় মেলার সমাপনি আসরে। প্রতিদিন কুইজ প্রতিযোগিতার সরাসরি মূল্যবান (বই) প্রাথমিক, সেমি ও মেগা পুরস্কার অত্যন্ত প্রাণবন্ত করে তোলে। ১৬ নভেম্বর ২০১৯ থেকে ৩১ নভেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত ১৬ দিন ব্যপী এর আয়োজন চলে। মেলাটির উদ্বোধনী দিনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে রঙ-বেরঙের ফেস্টুন, পতাকা এবং ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ী ও ব্যান্ডদল নিয়ে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কের মেলা প্রাঙ্গণে এসে পৌঁছায়। উদ্বোধনী পর্বে অতিথী হয়ে আসেন ও আলোচনা পেশ করেন- ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভাইস চান্সেলার জনাব অধ্যাপক আরিফিন সিদ্দিকী, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব আব্দুল মান্নান, খুলনা বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার আনোয়ার হোসেন হাওলাদার, জাতীয় গ্রন্থাগারের পরিচালক মিনার মুনসুর এবং রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র শিক্ষকসহ স্থানীয় প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক মহলের শীর্ষ ব্যক্তিগণ মঞ্চে উপবিষ্ট হন। তাঁরা তাঁদের আলোচনায় ও পরিদর্শনে মেলা সম্পর্কে অত্যন্ত মৌলিক ও ইতিবাচক মন্তব্য পেশ করেন। বইমেলাটি সাতক্ষীরা কেন্দ্রিয় পাবলিক লাইব্রেরির পঞ্চাশ বছর পূর্তী ও মুজিবর্ষকে উপলক্ষ করে আয়োজিত হয় এবং বিশেষ বিবেচনায় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের মাধ্যমে সংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের অনুদানপ্রাপ্ত হয়। তাছাড়া মুজিববর্ষকে সংযোগ করে বাংলাদেশে এটিই প্রথম কোন অনুষ্ঠান। সুতরাং এর মর্যাদা, গুরুত্ব ও মাত্রা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। প্রথমে ১৬ নভেম্বর’২০১৯ থেকে ২৫ নভেম্বর’২০১৯ পর্যন্ত এর সময় ধার্য থাকে। কিন্তু এর বিস্তৃত পরিসর ও সার্বিক আড়ম্বরতায় অভিভূত হয় এ জনপদের সকল মানুষ। তাই তাদের চাহিদা, প্রত্যাশা ও দাবির প্রতি সম্মান রেখে মেলার সময়সীমা ৩১ নভেম্বর’২০১৯ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এ উপলক্ষে শহরের কয়েকটি আতিগুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে মনোরম গেট বা তোরণ নির্মাণ করা হয়। জনবহুল ও বিশেষ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে টানিয়ে দেওয়া হয় বইমেলার লোগো, শ্লোগান, তথ্য ও বঙ্গবন্ধুর ছবি সংবলিত বিশালাকার ফেস্টুন। তাই সারা শহরময় এর একটা প্রভাব ও উৎসবি আমেজ বিরাজ করে। অনাস্বাদিতপূর্ব আনন্দ, অদ্ভূত বিস্ময় আর মুগ্ধতায় দোলা জাগায় সকলের অন্তরে। মূল মেলাতে অত্যন্ত নান্দনিক কারুকার্য সম্পন্ন ফটক (গেট) ও মেলা মাঠের বাহারি সাজবেশ সকলকে অভিভূত করে।
অত্যন্ত দুর্ভাগ্য ও দু:খের সাথে বলতে হয় যে, এত সব গতিময় উৎসাহ উদ্দীপনার পর পরই ২০১৯ সালের মে মাসে প্রাকৃতিক দূর্যোগ ‘ফনি’ ও তৎপরবর্তী ‘ডেঙ্গু’র প্রভাব এবং নভেম্বরে ‘বুলবুল। ২০২০ সালে মার্চে ভয়াবহ সংক্রামক ভাইরাস ‘করোনা’ এবং মে মাসে সাইক্লোন ‘আম্ফান’ এভাবে ধারাবহিক দুর্যোগী বিপর্যয়ের ঘনঘটায় অস্থির ও ল-ভ- দিক-দিগন্ত। বিশেষ করে ২০২০ সালে করোনার উগ্র আগ্রাসনের অকরুণ কারসাজির জটিল চক্রের আবর্তে স্থগিত হয়ে গেছে বই মেলার আবেদনী আয়োজন। প্রাণঘাতী সংক্রামক করোনা ভাইরাসের বিভৎসতায় হারিয়ে ও এলোমেলো হয়ে যায় বইমেলাসহ অন্যান্য সব আয়োজনের পরিকল্পিত পরিকল্পনা।
অবশেষে করোনা জনিত জড়োতার জটিলতা কাটিয়ে আবারও বঙ্গবন্ধুৃর জন্মশতবর্ষ, জাতিয় শিশুদিবস ও স্বধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ১৭ মার্চ-২০২১ থেকে ২৬ মার্চ-২০২১ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ফিরে এসেছিলো ‘বঙ্গবন্ধু বইমেলা’। দশদিন ব্যপি এ আয়োজনে জাতিয় কর্মসূচির সাথে সংগতি রেখে এর সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছিলো আবৃত্তি উৎসব, সাংস্কৃতি উৎসব, শিশু উৎসব, বীর মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চ, নাটক, প্রাসঙ্গিক আলোচনা ও আলোকচিত্র প্রদর্শন ইত্যাদি। এর পাশাপাশি ছিলো কুইজ ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা (অবৃত্তি, সংগীত, চিত্রাঙ্কন, গল্পবলা ইত্যাদি)। যা উৎসবি আমেজের বন্ধ্যাত্ব কাটিয়ে মানুষকে একইসাথে পরিচ্ছন্নতা, শৃঙ্খলা ও সুরক্ষা সচেতনতার পাশাপাশি উদ্যামী আর সাহসী করে তালে। শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে প্রাণবন্ত এ আয়োজনে মানুষ যেন আবদ্ধ জীবনের মুক্তি খুঁজে পায়। অবসান স্বেচ্ছা নির্বাসনের।
করোনার শিথিলতার মাঝেই জেলা প্রশাসনের আয়োজনে আমরা আবার বই মেলা করার সুযোগ করে নিতে পেরেছি। সেই ধারাবাহিকতায় নতুন জেলা প্রশাসক মোহাম্মাদ হুমায়ুন কবির মহোদয়ের তত্ত্বাবধানে ৩০ ডিসেম্বর ২০২১ হতে ২২ জানুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত ১৪ দিনব্যাপি বই মেলার আসর বসে। ২৯টি ষ্টল নিয়ে শহিদ আব্দুর রাজাক পার্কে এই বই মেলা যেন আবারও পাঠক. লেখক, প্রকাশক ও বিজ্ঞ জনের এক মিলন মেলায় পরিণত হয়ে উঠে। সংস্কৃতিবান্ধব সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় জেলা প্রশাসনের এ মহতি উদ্যোগে সাতক্ষীরাবাসীর স্বতষ্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও আনন্দ আরোহন আর এক দফা ঝেড়ে দেয় সকল জড়তা। ঘুচায় মলিনতা, অবশন্নতা। গ্রন্থলব্ধ জ্ঞানের আলোক ছটায় দূর হয় অন্তলোকের অন্ধকার।
২০২৩ সালের ২৫ ফ্রেরুয়ারি হতে ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এবং ২০২৪ সালে ১৯ ফেব্ররুয়ারী হতে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ০৩দিন ব্যাপি বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। ৩দিনের প্রচলন, তৎক্ষণিক স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি, বৃহৎ পরিসরে সংশ্লিষ্ট সংগঠন, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গের সাথে যথাযথ সমন্বয়হীনতা মেলার উন্নয়নশীল বিবর্তনকে খর্ব করেছে। সৃষ্টি হওয়া ক্রমবর্ধমান প্রত্যাশার সাথে যার সমন্বয় বেমানান। দৃষ্টান্ত অনুসরন করে এ ব্যাপারে দায়িত্বশীলদের দায়বদ্ধতায় আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন।
জ্ঞান মানুষের সুপ্ত অনুভূতি, অনুভব, উপলব্ধি ও মননী সৃজনীশক্তিকে তীক্ষè, কারুকার্যময়, ঐশ^র্যম-িত করে তোলে। আর বই-ই হতে পারে তার অনিবার্য পরিপূরক। বই মনুষ্যত্বের অপমান ও মানবতার অপধারণার বিরুদ্ধে প্রকৃত ন্যায়, যুক্তি, ও সত্যের মুখবন্ধ আবেদন সৃষ্টিতে সহায়ক হতে পারে। প্রেম-ভালোবাসা, নৈঃসর্গ, লৌকিক-অলৌকিক-অতিলৌকিক ও পরাবাস্তব চেতনাকে যথার্থ উচ্চকিতভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে এবং তা প্রকাশে উজ্জীবিত করে। ফলে ধ্রুপদি ভাবনার বস্তুনিষ্ঠ অর্জন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমরা নিঃসন্দেহে বইয়ের কাছে সমর্পিত। যাবতীয় মানবিক গুণাবলি হাসিলের সক্ষমতায় নির্ধারিত পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বিচিত্র বিষয়ের পঠন-পাঠন ও অনুশীলনের বিকল্প নেই। যুক্তি আইন ও বাস্তবতার সিদ্ধান্ত মাথায় রেখে অবিচারের চুড়ান্ত পরিণতির নাম স্বাধীনতা। কঠিন ত্যাগ ও মূল্যে অর্জিত সে স্বাধীনতা রক্ষা এবং সুফল ভোগে বইপড়া বা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চারও একটা যোগসূত্র আছে। ফলশ্রুতিতে একটি সার্থক বইমেলা মেলা পরিবেষ্টিত অঞ্চল বা জনপদে মনোগঠন ও আত্মিক উৎকর্ষ সাধনে প্রভাব ফেলে।
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বর্তমানে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় ও জাতীয় গণগ্রন্থগার ও জাতিয় গ্রন্থকেন্দ্র এর উদ্যোগে এবং স্থানীয় আয়োজনে বই মেলা যতেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। ব্যাপক আগ্রহ ও লোকসমাগমে তা সফল ও সার্থক হচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি যে, করোনা কালিন সংকট কাটিয়ে প্রজন্মের মৌলিক ও মননশীল আত্মচৈতন্য সৃষ্টিতে এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সমাজিক দায়, আর সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসার টানে দেশব্যপী এ বই মেলা।