অনলাইন ডেস্ক ::
ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর বেরিয়ে আসছে রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবন নির্মাণের নানা অনিয়ম। আটতলা আবাসিক কাম বাণিজ্যিক ভবনে ছিল না রেস্তোরাঁ ব্যবসার অনুমোদন। অথচ প্রায় প্রতিটি তলাতেই ধুমধামে চলেছে নামিদামি আটটি রেস্টুরেন্ট। ক্রেতা আকৃষ্ট করতে এগুলোর সাজসজ্জাও হয়েছিল খুবই দাহ্য উপকরণে। শুধু তাই নয়, যে ২২ শর্তে ফায়ার সেফটি প্ল্যানের অনুমোদন দিয়েছিল, তার একটিও কেউ অনুসরণ করেনি। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ তিন দফায় এসব নিয়ে নোটিশ দিলেও আমলে নেননি ভবন মালিকরা। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বৃহস্পতিবার রাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর গতকাল শুক্রবার রাজউক বোর্ড সদস্য (উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ) আবদুল আহাদকে প্রধান করে ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে। কমিটিতে প্রধান প্রকৌশলী, প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ, প্রধান স্থপতি, সংশ্লিষ্ট এলাকার অথরাইজড অফিসার, পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের সদস্য করা হয়েছে। তিন কর্মদিবসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
তদন্ত কমিটি গতকাল অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছে। কমিটির প্রধান আবদুল আহাদ জানিয়েছেন, গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ থাকার পরও ভবনের বিভিন্ন তলায় গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার হয়ে আসছিল। এ ধরনের ভবনে ফায়ার সার্ভিস কীভাবে ফায়ার সেফটি, সিটি করপোরেশন ট্রেড লাইসেন্স ও তিতাস কর্তৃপক্ষ গ্যাসের লাইন অনুমোদন দিল, তা পর্যালোচনা করবেন তারা। আগামীকাল রোববার কমিটি আনুষ্ঠানিক বৈঠক করবে। এর পরই বিস্তারিত জানা যাবে।
রাজউক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা জানান, ভবনের নকশা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। পরে বিস্তারিত জানানো হবে।
জানা গেছে, ২০১১ সালে ২ বেইলি রোডের ৭ দশমিক ২৮ কাঠা জমির ওপর বেজমেন্টসহ আটতলা ভবনের অনুমোদন দেয় রাজউক। বেজমেন্টে গাড়ি পার্কিং। চারতলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক; পঞ্চম থেকে আটতলা পর্যন্ত আবাসিক। বাণিজ্যিক অংশ কেবল অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হবে। নকশায় ভবনের সামনের রাস্তা ৯০ ফুট। ডেভেলপার হিসেবে ভবনটি তৈরি করে আমিন মোহাম্মদ ডেভেলপমেন্টস। নির্মাণের পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ফ্লোরগুলো কিনে নেয়।
কোনো ভবন অনুমোদন ও তৈরির সময় তদারকির ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে রাজউকের অথরাইজড অফিসারের। গ্রিন কোজি কটেজ তৈরির সময় ওই এলাকার অথরাজইড অফিসার ছিলেন খালিকুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বেশ কয়েক বছর আগে অবসরে গেছেন। বর্তমানে তিনি কোথায় আছেন, রাজউক থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
রাজউক বরাবর বলে আসছে, অনুমোদন দেওয়ার পর ভবনটি নকশা অনুযায়ী ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা তা তদারকির জন্য প্রয়োজনীয় জনবল তাদের নেই। এ জন্য রাজধানীর ভবনগুলোকে মনিটরিংয়ের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। ২০১৬ সালে গুলশানের হলি আর্টিসান ট্র্যাজেডির পর রাজউক আওতাধীন এলাকার ভবনগুলোর অকুপেন্সি সার্টিফিকেট (ভবন ব্যবহার ছাড়পত্র) গ্রহণ বাধ্যতামূলক করে। কিন্তু গ্রিন কোজি কটেজ ভবনের মালিকরা এ সনদ নেননি। দুর্ঘটনার পর ডেভেলপার ও ফ্লোর মালিকদের ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়নি। ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান আমিন মোহাম্মদ ডেভেলপমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনামুল হকের মোবাইল নম্বরও বন্ধ ছিল।
নকশা অনুমোদন-সংক্রান্ত কমিটির সদস্য রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী উজ্জ্বল মল্লিক বলেন, ‘বাধ্যতামূলক হওয়ায় গুলশান, বনানী, বারিধারা ও উত্তরায় বাড়ি বা ফ্ল্যাট মালিকরা অকুপেন্সি সনদ নেন। এ ছাড়া রাজধানীর অন্য এলাকার কেউ এটি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না। মালিকানা বদলের সময়ই কেবল অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নেওয়ার ঘটনা ঘটে।’
বেইলি রোড এলাকার সংশ্লিষ্ট বিল্ডিং ইন্সপেক্টর সুব্রত কর্মকারকে একাধিকবার কল দিলেও ধরেননি। অথরাইজড অফিসার জুটন দেবনাথও মন্তব্য করতে রাজি হননি।
জানা গেছে, গ্রিন কোজি কটেজের আট তলায় নামাজের স্থান, সাত তলায় রেস্টুরেন্ট ফুকো, হাককাকি চায়নিজ, ছয় তলায় রেস্টুরেন্ট স্ট্রিট ওভেন, রেস্টুরেন্ট জেস্ট্রি ফুড কোর্ট, পাঁচ তলায় রেস্টুরেন্ট পিজ্জা ইন, চার তলায় রেস্টুরেন্ট খানাস, কাওয়াজ, তিন তলায় এলিয়ন ফ্যাশন, দোতলায় রেস্টুরেন্ট কাচ্চি ভাই ও নিচতলায় স্যামসাং ইলেকট্রনিকসের শোরুম, জুসবার, রেস্টুরেন্ট মেজবানি খানা ও চা চুমুক নামের দোকান রয়েছে। প্রতিটি রেস্টুরেন্ট অবৈধভাবে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিল।
নগর গবেষক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘ভবনে রেস্তোরাঁ ব্যবসা পরিচালনার জন্য বিশেষ ধরনের আর্কিটেকচারাল ডিজাইন করতে হয়। কিন্তু রাজধানীর খুব কমসংখ্যক রেস্টুরেন্ট এমন ডিজাইনের ভবনে রয়েছে। কারণ ধোঁয়া কোন দিক দিয়ে বের হবে এবং অগ্নিঝুঁকি মাথায় রাখতে হয়। রেস্টুরেন্টের কোনো রকম ডিজাইন ছাড়াই ভবনটিতে অনেক রেস্তোরাঁ বছরের পর বছর ব্যবসা করে যাচ্ছিল। অথচ এত দিনেও রাজউক তা দেখতে পায়নি।’