ডেস্ক রিপোর্ট ::
প্রচন্ড তাপদহে তীব্র পানির সংকটে সাতক্ষীরা পৌরসভার অধিকাংশ এলাকার মানুষ। পানির জন্য সাতক্ষীরা শহরে হাহাকার শুরু হয়েছে। খাবার ও ব্যবহারের পানির জন্য সাতক্ষীরা শহরের মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। সাতক্ষীরা পৌরসভার পানির গ্রাহকদের সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে। যার সমাধান কোন ভাবেই হচ্ছেনা। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এ অবস্থা প্রকট হয়েছে। বর্তমানে পৌরসভার অধিকাংশ এলাকার গ্রাহকেরা খাবার পানির পাশাপাশি গোসল করার মতো পানিও পাচ্ছেন না। কিছু কিছু এলাকায় পানি পাওয়া যাচ্ছে খুবই সীমিত।
দৈনিক পত্রদূত সরেজমিন ঘুরে দেখতে পায়, সাতক্ষীরা পৌরসভার রসুলপুর, পলাশপোল, মুনজিতপুর, দক্ষিণ কাটিয়া, উত্তর কাটিয়া, লস্করপাড়া, মাস্টারপাড়া, কাছারিপাড়া, সরকারপাড়া, মধুমোল্লাডাঙ্গী, রাজারবাগান, ইটাগাছা, কামালনগর, গড়েরকান্দা, মুন্সিপাড়ার একাংশ, পুরোনো সাতক্ষীরা, সুলতানপুরের একটা অংশ, পারকুকরালি, মিয়া সাহেবেরডাঙ্গীসহ শহরের অধিকাংশ স্থানে দীর্ঘদিন ধরে প্রয়োজনীয় পানি পাচ্ছেন না গ্রাহকেরা।
পৌরসভা সূত্রে জানা যায়, মোট সাড়ে আট হাজার গ্রাহকের প্রতিদিন পানির চাহিদা আছে প্রায় সাড়ে ৯হাজার ঘনফুট কিন্তু পানি সরবরাহ আছে ৭হাজার ঘনফুট। আড়াই হাজার ঘনফুট পানির ঘাটতি যেটার কারণে জনগণকে দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
সাতক্ষীরা রসুলপুর এলাকার এড. মুনির উদ্দিন বলেন, পানির সমস্যা আসলে দীর্ঘদিনের কিন্তু এই সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে এই প্রচন্ড তাপের কারণে। আগে প্রতিদিন ২ থেকে ৩ বার পেতাম কিন্তু একবার পাওয়াও কঠিন। টিউবওয়েলের পানি ব্যাবহার করবো কিন্তু আয়রনের ভয়ে তাও পারিনা। আমরা অতি দ্রুত এর সমস্যার সমাধান চাই।
সাতক্ষীরা শহরের সুলতানপুর এলাকার আমিনুর রহমান জানান, কয়েক মাস ধরে তিনিসহ আশেপাশের কেউ ঠিক মতো পানি পাচ্ছেন না। আগে মাঝেমধ্যে খাবার জন্য পানির সরবরাহ পাওয়া গেলেও গরম পড়া ধরে তা একেবারেই পাচ্ছেন না।
সাতক্ষীরার উত্তর কাটিয়ার জাফর আহমেদ বলেন, বিগত এক সপ্তাহ ধরে খাবার পানিটুকুও পাচ্ছিনা। অন্যের বাড়ির টিউবওয়েল থেকে পানি আনতে হচ্ছে। তাও কস পানি।
কাটিয়া মাস্টার পাড়ার স্বাধীন পারভেজ বলেন, প্রতিদিন সন্ধ্যায় লাইন দিয়ে ১পট করে খাবার পানি পাচ্ছি, যেটা দিয়ে সারাদিন চলে না। ৪০টাকা করে পানির ড্রাম কিনে চালাতে হচ্ছে।
ইটাগাছা এলাকার আব্দুল খালেক বলেন, পানির বিল ঠিকমতো দিলেও দীর্ঘদিন ধরে পানি পাইনা। ভ্রাম্যমান গাড়িতে পানি সাপ্লাই দিলেও সবদিন পাইনা। ভ্রাম্যমাণ পানির গাড়ি কখন আসে আর কখন যায় তা কেউ জানতে পারে না। পানির কষ্টে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জীবন।
সাতক্ষীরা শহরের রাজারবাগান এলাকার সাকলাইন বলেন, চাকরি করার সুবাদে বাইরে থাকি সপ্তাহে ২দিন বাড়ি আসি কিন্তু এসে ঠিক মতো না পারছি গোসল করার পানি, না পাচ্ছি খাওয়ার পানি। কেনা পানি দিয়ে চালাতে হচ্ছে।
সাতক্ষীরার সন্তান সাবেক ফিফা রেফারি তোয়েব হাসান শামসুজ্জামান বাবু বলেন, পৌরসভার পানির সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে। এটি আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে, এই মৌসুমে প্রচন্ড তাপদহের কারণে। এই সমস্যার সমাধান করতে আসলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়ন করা অপরিহার্য। এই বিষয়ে আমি পৌরকর্তৃপক্ষ জনপ্রতিনিধি স্থানীয় সরকার ও জনপ্রশাসন সহ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, যেনো অতি দ্রুত এর সমস্যা সমাধান করে জনগণের দুর্ভোগ লাভ করা যায়।
সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির আহবায়ক আজাদ হোসেন বেলাল বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সঠিকভাবে পানি সরবরাহ দিচ্ছে না সাতক্ষীরা পৌরসভার। বিভিন্ন অঞ্চলে পানি পায় আবার পায় না, আবার পানি ঘোলা ময়লা আবর্জনা যুক্ত। এর সমাধান জানতে চাইলে বলেন, নিজস্ব উদ্যোগে ডিপ টিউবওয়েল বসাতে হবে।
সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির যুগ্ম সদস্য সচিব ও গণফোরামের আহবায়ক আলী নুর খান বাবলু বলেন, সাতক্ষীরা পৌরসভায় যতগুলো মোটর আছে তার অধিকাংশই অকেজো হয়ে পড়ে আছে, যা মেরামতের জন্য প্রতিবার ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা পকেটে পুড়ছে। এই মোটরগুলো যদি নতুন করে স্থাপন করা যায় তাহলে পৌরসভার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ সুপেয় পানি পাবে। তিনি আরও বলেন, পৌরসভার পানি বিভাগে যারা আছেন এদের উদাসীনতা এবং পৌরসভার অভ্যন্তরীণ গোলযোগের কারণে পৌরসভার কয়েক লক্ষ মানুষকে এরা জিম্মি করে রেখেছে।
সাতক্ষীরা পৌরসভার পানি সরবরাহ কেন্দ্রের সহকারী প্রকৌশলী সেলিম সরোয়ার জানান, তীব্র তাপদহের কারণে পানির লেয়ারটা কমে গেছে। যেটা থাকার কথা ২৫ থেকে ২৯ কিন্তু নেমে এটা এখন ৪২ থেকে ৪৫ যার কারণে পানিটা ঠিকমতো উঠছে না। কোন যান্ত্রিক ত্রুটি আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি পত্রদূতকে জানান, যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল কাটিয়াতে কিন্তু দু’দিন আগে আমরা সেটা মেরামত করেছি। তিনি আরো বলেন, আমাদের পানি শাখায় ৬ থেকে ৭ মাস বেতন বন্ধ এবং বিদ্যুৎ বিল বকেয়া আছে সাড়ে ৬ কোটি টাকা।
কাজী ফিরোজ হাসান (ভারপ্রাপ্ত, পৌর মেয়র) বলেন, প্রচন্ড তাপদাহের কারণে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পুরোপুরিভাবে পানি সরবরাহ করাটা কঠিন হয়ে পড়ছে, তবে পুরো পৌরসভা নয় কয়েকটি ওয়ার্ডে পানি পাচ্ছে না বলে উল্লেখ করে বলেন ৭, ৮ এবং ১নং ওয়ার্ডের এর কিছু অংশ নিয়মিত পানি পাচ্ছে না। বিকল্প কোন ব্যবস্থা আছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, ইতোমধ্যে আমরা আলোচনা করেছি ৪টা বড় সাবমারসিবল পাম্প বসানোর জন্য। খুব দ্রুত আমরা টেন্ডারে চলে যাব। তিনি আরও বলেন, ৭ এবং ৮নম্বর ওয়ার্ডের মাঝামাঝি জায়গায় একটা বসাবো, ৯নং ওয়ার্ডে একটা বসাবো, গদাই বিল এলাকায় একটা বসাবো এবং আরেকটি বসবে রাজ্জাক পার্কে। তিনি বিদ্যুৎ বিলের প্রতি ইউনিটের দাম উল্লেখ করে বলেন, যে হারে বিদ্যুৎ বিল বাড়ছে সেখানে এই টাকায় পানি সরবরাহ করতে থাকলে পৌরসভা দেউলিয়া হয়ে যাবে। সর্বশেষ খুব দ্রুত এই সমস্যার সমাধান হবে বলে আশ্বাস দেন।
৭নং ওয়ার্ডের পৌর কাউন্সিলর শেখ জাহাঙ্গীর হোসেন কালু বলেন, ইটাগাছা যে পাম্পটা আছে সেই পাম্প তার নিচে যে ফিল্টার আছে সেটি ফেটে গেছে এবং এখানে বড় মটর লাগালে প্যড়ে যায় যার কারণে ঠিক মতো আমার ওয়ার্ডের পানি পাচ্ছেনা জনগণ। এর সমাধান হিসেবে আমি সকাল ও সন্ধ্যায় অল্প অল্প করে পৌরসভার ট্রাকে করে চালতেতলা থেকে পানি এনে সরবরাহ করছি।
৮নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো: শফিকুল আলম বাবু বলেন, বিগত দীর্ঘদিন ধরে আমার ওয়ার্ডে পানি পাচ্ছিনা। কারণ হিসেবে বলেন, প্রচন্ড তাপদহের কারণে পানির লেয়ার নিচে নেমে যাওয়ার জন্য এই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে জনগণকে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা পথ খুজছি।
৯নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শেখ শফিক উদ দৌলা সাগর বলেন, এই প্রচন্ড গরমে পানির লেয়ার প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ ইঞ্চি নিচে নেমে যাচ্ছে। এমনকি অনেক বাড়িতে শ্যালো মেশিন এবং টিউবওয়েলের পানিও উঠছেনা। আমরা যে খুব প্রেসার দিয়ে পানি টেনে তুলবো ভোল্টেজের কারণে সেটাও পারছিনা মটর জ্বলে যাচ্ছে আর একবার এই মটর জ্বলে গেলে ঢাকা থেকে মিস্ত্রি এনে মেরামত করতে একমাস সময় লেগে যায়। সমাধান হিসেবে বলেন, আমাদের স্টেডিয়ামের সামনে এবং চৌরঙ্গী মোড়ে বড় মটর বসানো আছে এখান থেকে যে কেউ পানি নিতে পারবে সবাইকে ধৈর্য ধরার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করেছেন।
১, ২ ও ৩ নং রক্ষিত মহিলা সদস্য নুর জাহান খাতুন বলেন, আল্লাহর পানি আল্লাহ বন্ধ করে দিছে এর জন্য আমার আমাদের করণীয় কি! সাপ্লাই পানি নেই, মটরে পানি নেই, আমরা যে একটু পুকুরের পানি দিয়ে কাজ-কাম করবো তাও সব পুকুর ভরাট হয়ে গেছে।